alt

উপ-সম্পাদকীয়

পানি নিয়ে ভাবনার এখনই সময়

এস ডি সুব্রত

: রোববার, ২৪ মার্চ ২০২৪

পানির অন্য নাম জীবন। অথচ পানির অপচয় ও দূষণ নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন নই।

পানি জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। যেখানে পানির উৎস বেশি, সেখানে প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপস্থিতি বেশি হতে দেখা যায়। মানুষের খাওয়া, ব্যবহার, শস্য ও পণ্য উৎপাদন, নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণে পানি ছাড়া উপায় নেই। তাই অতীতে পানি সংকটে কোটি মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ পানি ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। ২০৩০ সালের দিকে তীব্র পানি সংকটে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ দেশের মধ্যে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে।

আমরা পানির ব্যবহার নিয়ে ভাবি না এবং পানিকে গুরুত্বসহকারে নেই না। ফলে সুপেয় পানির অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। দিন দিন কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। বেঁচে থাকার জন্য পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানিপ্রাপ্তি একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির মজুুত দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশসহ বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। পানির সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে।

আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ এই দুই উৎস। অথচ পানি দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার আজ নেই বললেই চলে। তাই বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক আধার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পানি সংকটের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।

সারা পৃথিবীর মানুষ বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে যথাসাধ্য ব্যবহার করছে। অথচ এই উৎস লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে সাধারণ মানুষ সেই সম্পর্কে জানতে পারছে না। যেহেতু এটা সসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সেহেতু এই সম্পদের অপচয়, অবহেলা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই সম্পদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই আমাদের সবার উচিত পানি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পরিমিত ব্যবহার ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা রাখা। তা না হলে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থেকে খুব সহজে আমাদের উত্তরণের কোনো পথ নেই। এখনই সময় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প পানি ব্যবহারের উৎস সন্ধান ও এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া।

কল-কারখানার দূষিত রসায়নিক পদার্থ, কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশক সার, নৌযানের ভাঙা অংশ, তেল, মবিল, তেলজাতীয় সামগ্রী (যা সরাসরি নদীতে ফেলা হয়) পানি দূষণের প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে ছোট-বড় কল-কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ছাপাখানা, টেক্সটাইলের বিষাক্ত রাসায়নিক রং, গার্মেন্টস কারখানার ব্যবহৃত পানি, ট্যানারির মারাত্মক পানিদূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত করছে।

বড় বড় শহরের যাবতীয় বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ে নদীতে, যা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। এই ভূ-উপরিস্থ দূষিত পানি বিভিন্ন উপায়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করছে। ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ও পানির স্তর কমে যাওয়ার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানিদূষণই দায়ী। আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে ব্যাপক পানি দূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানিদূষণ বন্ধ করা। আর পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী খালবিল, সমুদ্র ইত্যাদি। তাই ভূ-উপরিস্থ পানিকে পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদ-নদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যের মিশ্রণরোধ করা অত্যাবশ্যক। নদীতীরে শিল্পকারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেই সঙ্গে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্পকারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্র্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক।

নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যরে মিশ্রণ প্রতিহত করতে হবে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদ-নদী দূষণরোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার এবং সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদীনালা, খালবিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুত বাড়ে। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমনÑ হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এসব রক্ষা করতে হবে। গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় বেশি বেশি ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন করে পুনঃব্যবহার করতে হবে। পানি পুনঃব্যবহরের উন্নত পদ্ধতি বের করার জন্য গবেষণা বাড়াতে হবে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দেশব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূ-অভ্যান্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়।

ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, দূষণরোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করতে হবে। যাতে করে পৃথিবী আরও বেশি দিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানিদূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে। তাই আমাদের সবার উচিত এ বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে সুপেয় পানি সংকটের অন্যতম কারণ হলো ভূগর্ভস্থ স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ পানির চাহিদা বাড়ছে আর যে হারে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গায় বর্ষার মৌসুমে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সে কারণে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে অতিদ্রুত কাজ করা উচিত। পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ মনে করেন, পানি সরবরাহে ওয়াসার মনিটরিং সিস্টেম কার্যকর করতে হলে বিদেশি সফল মডেলগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। এই সিস্টেমটা যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও পানি দূষণরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুপেয় পানির একটা ভালো ব্যবস্থা রেখে যেতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

পানি নিয়ে ভাবনার এখনই সময়

এস ডি সুব্রত

রোববার, ২৪ মার্চ ২০২৪

পানির অন্য নাম জীবন। অথচ পানির অপচয় ও দূষণ নিয়ে আমরা মোটেও সচেতন নই।

পানি জীবনের একটি মৌলিক চাহিদা। যেখানে পানির উৎস বেশি, সেখানে প্রাণী এবং উদ্ভিদের উপস্থিতি বেশি হতে দেখা যায়। মানুষের খাওয়া, ব্যবহার, শস্য ও পণ্য উৎপাদন, নির্মাণ ও অগ্নিনির্বাপণে পানি ছাড়া উপায় নেই। তাই অতীতে পানি সংকটে কোটি মানুষ নিজেদের বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষ পানি ঘাটতির সমস্যায় পড়েছে। ২০৩০ সালের দিকে তীব্র পানি সংকটে প্রায় ৭০ কোটি মানুষ দেশের মধ্যে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হবে।

আমরা পানির ব্যবহার নিয়ে ভাবি না এবং পানিকে গুরুত্বসহকারে নেই না। ফলে সুপেয় পানির অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। দিন দিন কমছে বিশুদ্ধ পানির উৎস। বেঁচে থাকার জন্য পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদান হলেও আমাদের দেশে সুপেয় পানিপ্রাপ্তি একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ পানির মজুুত দিন দিন কমে যাচ্ছে, যা আমাদের দেশসহ বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। পানির সমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করছে।

আমাদের দেশে সুপেয় পানির সংস্থান ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ এই দুই উৎস। অথচ পানি দূষণের ফলে বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার আজ নেই বললেই চলে। তাই বিশুদ্ধ পানির প্রাকৃতিক আধার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যা ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের বিশুদ্ধ পানির ভবিষ্যৎ সংস্থান চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এখনই এ বিষয়ে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ পানি সংকটের মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।

সারা পৃথিবীর মানুষ বিশুদ্ধ পানির জন্য ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকে যথাসাধ্য ব্যবহার করছে। অথচ এই উৎস লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকার কারণে সাধারণ মানুষ সেই সম্পর্কে জানতে পারছে না। যেহেতু এটা সসীম প্রাকৃতিক সম্পদ, সেহেতু এই সম্পদের অপচয়, অবহেলা এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার এই সম্পদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাই আমাদের সবার উচিত পানি সম্পর্কে সচেতন হওয়া, পরিমিত ব্যবহার ও ভূগর্ভস্থ পানি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা রাখা। তা না হলে বিশুদ্ধ পানির সমস্যা থেকে খুব সহজে আমাদের উত্তরণের কোনো পথ নেই। এখনই সময় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প পানি ব্যবহারের উৎস সন্ধান ও এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া।

কল-কারখানার দূষিত রসায়নিক পদার্থ, কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কীটনাশক সার, নৌযানের ভাঙা অংশ, তেল, মবিল, তেলজাতীয় সামগ্রী (যা সরাসরি নদীতে ফেলা হয়) পানি দূষণের প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে ছোট-বড় কল-কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্য, ছাপাখানা, টেক্সটাইলের বিষাক্ত রাসায়নিক রং, গার্মেন্টস কারখানার ব্যবহৃত পানি, ট্যানারির মারাত্মক পানিদূষণকারী রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি প্রতিনিয়ত নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত করছে।

বড় বড় শহরের যাবতীয় বর্জ্য সরাসরি গিয়ে পড়ে নদীতে, যা ভূ-উপরিস্থ পানিকে ব্যাপকভাবে দূষিত করছে। এই ভূ-উপরিস্থ দূষিত পানি বিভিন্ন উপায়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করছে। ভূগর্ভস্থ পানির দূষণ ও পানির স্তর কমে যাওয়ার জন্য ভূ-উপরিস্থ পানিদূষণই দায়ী। আমাদের দেশসহ সারাবিশ্বে ব্যাপক পানি দূষণের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির অবস্থা শোচনীয়। যার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। তাই এখনই আমাদের উচিত ভূগর্ভস্থ পানি রক্ষা করার জন্য ব্যাপক পানিদূষণ বন্ধ করা। আর পানি দূষণের প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে নদনদী খালবিল, সমুদ্র ইত্যাদি। তাই ভূ-উপরিস্থ পানিকে পানিদূষণের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নদ-নদীতে সব ধরনের কঠিন, গৃহস্থালি ও সেনিটারি বর্জ্যের মিশ্রণরোধ করা অত্যাবশ্যক। নদীতীরে শিল্পকারখানা নির্মাণ বন্ধ, সেই সঙ্গে দেশের বড় বড় শিল্প জোনের শিল্পকারখানার রাসায়নিক ও ট্যানারি বর্র্জ্য পরিশোধন বাধ্যতামূলক করা এবং এর নিরাপদ অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। তাই প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে শোধনাগার বা অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা আবশ্যক।

নদী ও সমুদ্রের পাড়ে জাহাজভাঙা শিল্প, লঞ্চ, স্টিমার নির্মাণসহ মেরামতকালে নদী ও সমুদ্রের পানিতে কারখানার তৈলাক্ত বর্জ্যরে মিশ্রণ প্রতিহত করতে হবে। কৃষিজমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মিশ্রিত পানি যাতে খাল-বিল-নদীতে মিশতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিতসহ পানি দূষণকারীদের আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। নদ-নদী দূষণরোধে দেশের আপামর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার এবং সচেতন জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে হলে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ হারে বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পানিদূষণ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রোধ করার জন্য ব্যাপক নীতিমালা গ্রহণ করার পাশাপাশি নদীনালা, খালবিল ইত্যাদি ব্যাপকভাবে খনন করতে হবে। যাতে ভূ-উপরিস্থ পানির মজুত বাড়ে। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক জলাশয় যেমনÑ হ্রদ, পুকুর, দিঘি, ডোবা ইত্যাদি ভরাট করা যাবে না। প্রয়োজনে আইন করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে এসব রক্ষা করতে হবে। গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় বেশি বেশি ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং ব্যবহৃত পানিকে পরিশোধন করে পুনঃব্যবহার করতে হবে। পানি পুনঃব্যবহরের উন্নত পদ্ধতি বের করার জন্য গবেষণা বাড়াতে হবে এবং বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দেশব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচারণা করে বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সর্বোচ্চ ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারি উদ্যোগে বৃষ্টির পানি সরাসরি ভূ-অভ্যান্তরে প্রবেশ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের উন্নতি হয়।

ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমানো, দূষণরোধ এবং এর বিকল্প উৎসের সংস্থান করতে হবে। যাতে করে পৃথিবী আরও বেশি দিন এই উৎস থেকে পানি আহরণ করতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পানিদূষণের কারণে পৃথিবীতে আজ বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ চরম হুমকিতে। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক ভূগর্ভস্থ পানিও যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকির মুখে পড়বে। তাই আমাদের সবার উচিত এ বিষয়ে যথাযথ সচেতনতা বৃদ্ধি করা। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে সুপেয় পানি সংকটের অন্যতম কারণ হলো ভূগর্ভস্থ স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ পানির চাহিদা বাড়ছে আর যে হারে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গায় বর্ষার মৌসুমে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সে কারণে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে অতিদ্রুত কাজ করা উচিত। পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ মনে করেন, পানি সরবরাহে ওয়াসার মনিটরিং সিস্টেম কার্যকর করতে হলে বিদেশি সফল মডেলগুলোকে অনুসরণ করতে হবে। এই সিস্টেমটা যেন ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও পানি দূষণরোধে ভূমিকা পালন করতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সুপেয় পানির একটা ভালো ব্যবস্থা রেখে যেতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top