মোহাম্মদ আবু নোমান
বারবার কেন আমরা পৃথিবীর দূষিত শহরের শীর্ষে; এ দূষণ ‘উন্নয়নের’ রহস্য জানতে বিশ্বকে গবেষণায় যেতে হবে! বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরে বসবাস করেও আমরা এখনও বেঁচে আছি। ঢাকা সেই শহর, যা এখন বিশ্ব দরবারে বাসযোগ্যতায় নিকৃষ্ট নগরী হিসেবে উপস্থাপিত। আমরা ঢাকার রোডে চলাচলের সময় ‘কস্ট ফ্রি’ যে পরিমাণে ধুলো (পাউডার) খাই, তা অন্য উন্নত দেশে পয়সা দিয়েও পাওয়া যাবে না। এ যেন অরক্ষিত মৃত্যু ফাঁদ! এ কি আমাদের সোনার বাংলা? টাইম অ্যান্ড অ্যাগেইন রেকর্ড তৈরি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। বারবার, বহুবার প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিজেদের কতমাত্রার ধন্য মনে করছেন তা আমরা জানতে চাই। অবশ্যই শীর্ষে থাকবে দেশ, বাংলাদেশকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। অ্যাওয়ার্ড প্লিজ! বাংলাদেশই এর যোগ্য। সাব্বাস বাংলাদেশ সাব্বাস! পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়! আহা! গর্বে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার অবস্থা! খালি রেকর্ড আর রেকর্ড! সরকারি কর্তৃপক্ষ মিলেমিশে পূর্বের মতোই এই সাফল্য কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আমরা র্যাংকিং ওয়ানে থাকতে চাই। আমরা হলাম সেরাদের সেরা! মাঝে মধ্যে আমরা অল্পের জন্য প্রথম স্থান হারিয়ে থাকি।
বায়ুমানের দিক থেকে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত পাঁচ দেশের মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশে। আর নগর হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা, একেবারে শীর্ষ অবস্থান ভারতের রাজধানী দিল্লির। গত ১৯ মার্চ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক আইকিউএয়ারের সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সেই সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে।
আগে তো জীবন তারপর সবকিছু। ঢাকার বায়ুদূষণের সমস্যাটি কেনো স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে? এ যেনো ‘বিনা পয়সার’ সদয়, যা সবাইকে ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছায় হোক, নাকে, চোখে, মুখে, শুধু ভোগই নয়, উপভোগও করতে হবে। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা বা রাত কোনো সময়ই, ঘরে বাইরে যার ছোঁয়া থেকে মুক্তি নেই; তা হলোÑ মারাÍক অস্বাস্থ্যকর ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্বলিত দুঃসহ, ভয়াবহ জীবনসংহারী ধুলা আর ধোঁয়া! বহু আগেই ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
এখন মহামারি থেকেও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে তাকালে চোখ বেয়ে পানি চলে আসে। সাধারণ মানুষের তো আর দুর্নীতি ও ঘুষের টাকা নেই। অন্যের দারে দারে চাইবার উপায় নেই। তাই সরকারের দৃষ্টি আকার্ষণ করে বলছি, দেশের উন্নয়নের সাথে আগে দেশের দিনমজুর ও গরিব অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকান। যেকোনোভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে নিম্নআয়ের মানুষগুলোকে বাঁচান।
দূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রথম স্থান হওয়ার এ অর্জনটা আমাদের অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের চরম আন্তরিক প্রচেষ্টার ফল! আমাদের খোঁড়াখুড়ি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যুৎ, ওয়াসা, ডেসা আমাদের দুই সিটির দুই নগর পিতা আছেন তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছেন; আর সব চেয়ে বেশি আমাদের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের, যারা ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, লেগুনা, পিকআপ দিয়ে শহরের জন্য আকাশ ভরা ‘তারা’ করে রেখেছেন। এদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেয়া যেতে পারে।
দূষণে শতবার শীর্ষে থাকা কি উন্নয়নের জোয়ারের ‘সাইড ইফেক্ট’! সাফল্যের শ্রীবৃদ্ধির, তুঙ্গে আমরা। এরপরও যারা বলবে উন্নয়ন হয়নি, জনগণ তাদের চিনে রাখবে! আমরা তো উন্নয়নের রোল মডেল, ডিজিটাল বাংলাদেশের রোল মডেলের। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। রাতে কেবলই মশার আলতো ছোঁয়া, দিনে ধুলো-বালি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, বাহ্ কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
কাজলা-গুলিস্তান টু চাঁনখারপুল ফ্লাইওভার চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। এখন ২০২৪। এত বছর পরেও ফ্লাইওভারের নিচে যে ধুলা-বালি সেগুলো অপসারণ করা হয়নি। উল্টো বেড়ার মতো করে এগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করে আর ধুলা-কুয়াশার মতো উড়ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়ায় মাঝে মাঝে মনে হয় যেন কুয়াশার আস্তরণে শহর ঢাকা পড়েছে। কর্তৃপক্ষের কোন খেয়াল আছে কি এসবের প্রতি?
আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ, মাছ-ফল-সব্জিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছুর ঝুঁকি নিয়েই আমরা চলছি! এটি সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। সব যায়গায় সমস্যা! এসব দেখারও যেন কেউ নেই! অনুধাবন, বা অনুভাবন করারও যেন কেউ নেই! হায়রে দেশ! হায়রে মানুষ! শুধু কি বায়ুদূষণ? বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ডের মধ্যে অনেক কিছুতেই শীর্ষে। বিশ্বের মধ্যে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানোতে আমরাই বিশ্বে প্রথম। এছাড়া ভাষা দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ, শিক্ষা দূষণ, যানজটের দূষণ কত কি? সাথে রাজনীতি, নির্বাচন, প্রশাসনের কথা নাই থাকলো। দূষণ, দুর্নীতি, ধর্ষণ যেনো দেশব্যাপী উইরা উইরা ঘুরে বেরোচ্ছে! শুধু বায়ু দূষিত না, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষগুলো দুর্নীতির দূষণে দূষিত। আর সার্বিক দুর্নীতির সরল সমীকরণ হল এই বায়ুদূষণ! কারণ আমাদের মাথাই এখন দূষিত; চুরি, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, ফাঁকিবাজি, লুটপাট মোট কথা ভেজাল, দূষণ ছাড়া আমরা কিছুই বুঝিনা, তা সে যেভাবেই হোক হতে হবে, রডের বদলে বাঁশ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে হোক বা হাঁটুপানিতে ঢালাই ঢেলে হোক!
সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের শিক্ষাঙ্গনে নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু ঢাকার ভিকারুননিসা, চট্টগ্রাম কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেওয়া, চাকরির প্রলোভন দেখানো, বিশেষ কোনো সুবিধা আদায়ের টোপে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকরা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠছেন। পরিবার, সমাজ কিংবা নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ফলে জীবনের বিষাদময় এসব ঘটনা বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক নারী শিক্ষার্থী।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় শিশু ও নারীদের দূষণজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। বাড়ন্ত শিশুর ফুসফুস ও স্নায়ুর বিকাশের জন্য দূষিত বাতাস খুবই ক্ষতিকর। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, তার বেশির ভাগেরই কারণ বায়ুদূষণ। শিশুরা তুলনামূলকভাবে বড়দের চেয়ে বেশি দ্রুত শ্বাস নেওয়ায় তাদের ওজনের তুলনায় বেশি বাতাস গ্রহণ করে। আর দূষিত বাতাস বেশি গ্রহণ করা মানে, বেশি বেশি জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়া।
শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম থাকে এবং এই পাঁচ মাসে সারা বছরের ৬০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বাকি সাত মাসে সারা বছরের ৪০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এজন্য শুষ্ক মৌসুমে যদি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে মানুষকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচা সম্ভব। এছাড়া আমাদের যে জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন ও মেট্রোলজিক্যাল কন্ডিশন, সেখানে বছরে সাত মাসই বৃষ্টিপাতের কারণে বায়ুদূষণের পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যায়। বাকি চার মাসের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলার কি খুবই প্রয়োজন? যদি ফিটনেস আছে এমন গাড়ি রাখা হয় এবং ভালোমানের গণপরিবহন চালু করা যায়, এক্ষেত্রে যে ১৫ ভাগ বায়ুদূষণ হয় সেটি অনেক কমে আসবে।
সরকারকে প্রথমে মানুষের জীবনকে মূল্যায়ন করাটা শিখতে হবে এবং মানুষের জীবনের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারপর উন্নয়নকে ঢেলে সাজাতে হবে। মানুষের কাছে জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও ফেরত আসতে হবে। আর যেসব বায়ুদূষণকারী শিল্প প্রকল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকল্প আছে সরকারকে অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে বলে আমরা মনে করছি।
বাস্তবতা হলোÑ আমরাই নোংরা তাই আমাদের দেশের পরিবেশও নোংরা। আমরা যে একটা শৃঙ্খলাবিহীন জাতি। এর জন্য দায়ী আমরাই, কারণ আমরা নির্দিষ্ট স্থানে কখনো ময়লা আবর্জনা ফেলি না। আসলেই আমরা নান্দনিক রুচি জ্ঞানহীন, অপরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ অসচেতন। দূষণে শীর্ষ অবস্থানের দায় কী শুধুই সরকারের! যত্র-তত্র পলিথিন, আবর্জনা কি আমরা ফেলি না! আপনার হাতে এখন যে আবর্জনার প্যাকেট বা পরিত্যক্ত বস্তুটি আছে তা কোথায় ফেলবেন, ভেবেছেন কী?
ঢাকা কেন বারবার দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সিটি কর্পোরেশন, সড়ক পরিবহন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? সরকারেরও সুমতি হবে না? বাংলাদেশের সরকারি প্রায় সব অফিসের কর্তারা বসে বসে বেতন নিতে আগ্রহী। কাজ করতে আগ্রহী নয়। বায়ুদূষণ রোধে অনেকগুলো সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
সুনির্দিষ্ট এবং সুচারু পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায় না। ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের কি পরিকল্পনা আছে তা আমাদের বলুন। আর জানা না থাকলে শুধু আমলাবেষ্টিত না থেকে এনভায়রনমেন্টাল এবং আরবান এক্সপার্টদের নিয়ে বসুন। বায়ুদূষণ রোধের উপায় বের করুন!
শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, ফ্যাক্টরি, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখতে হবে। সর্বসাধারণেরও সচেতন হওয়া জরুরি। রাস্তায় যেসব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়, সেগুলোই জীবাণু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা সৃঙ্খল না হবো, ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন; যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশেই সম্ভব সমাজ, দেশ ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]
মোহাম্মদ আবু নোমান
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
বারবার কেন আমরা পৃথিবীর দূষিত শহরের শীর্ষে; এ দূষণ ‘উন্নয়নের’ রহস্য জানতে বিশ্বকে গবেষণায় যেতে হবে! বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরে বসবাস করেও আমরা এখনও বেঁচে আছি। ঢাকা সেই শহর, যা এখন বিশ্ব দরবারে বাসযোগ্যতায় নিকৃষ্ট নগরী হিসেবে উপস্থাপিত। আমরা ঢাকার রোডে চলাচলের সময় ‘কস্ট ফ্রি’ যে পরিমাণে ধুলো (পাউডার) খাই, তা অন্য উন্নত দেশে পয়সা দিয়েও পাওয়া যাবে না। এ যেন অরক্ষিত মৃত্যু ফাঁদ! এ কি আমাদের সোনার বাংলা? টাইম অ্যান্ড অ্যাগেইন রেকর্ড তৈরি করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। বারবার, বহুবার প্রথম স্থান অধিকার করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিজেদের কতমাত্রার ধন্য মনে করছেন তা আমরা জানতে চাই। অবশ্যই শীর্ষে থাকবে দেশ, বাংলাদেশকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। অ্যাওয়ার্ড প্লিজ! বাংলাদেশই এর যোগ্য। সাব্বাস বাংলাদেশ সাব্বাস! পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়! আহা! গর্বে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার অবস্থা! খালি রেকর্ড আর রেকর্ড! সরকারি কর্তৃপক্ষ মিলেমিশে পূর্বের মতোই এই সাফল্য কতদিন ধরে রাখতে পারবেন তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আমরা র্যাংকিং ওয়ানে থাকতে চাই। আমরা হলাম সেরাদের সেরা! মাঝে মধ্যে আমরা অল্পের জন্য প্রথম স্থান হারিয়ে থাকি।
বায়ুমানের দিক থেকে ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত পাঁচ দেশের মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে বাংলাদেশের নাম। বায়ুদূষণে ২০২৩ সালে দেশ হিসেবে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশে। আর নগর হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ নগর ছিল ঢাকা, একেবারে শীর্ষ অবস্থান ভারতের রাজধানী দিল্লির। গত ১৯ মার্চ সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ু মান প্রতিবেদন ২০২৩’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক আইকিউএয়ারের সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সেই সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে।
আগে তো জীবন তারপর সবকিছু। ঢাকার বায়ুদূষণের সমস্যাটি কেনো স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে? এ যেনো ‘বিনা পয়সার’ সদয়, যা সবাইকে ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছায় হোক, নাকে, চোখে, মুখে, শুধু ভোগই নয়, উপভোগও করতে হবে। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা বা রাত কোনো সময়ই, ঘরে বাইরে যার ছোঁয়া থেকে মুক্তি নেই; তা হলোÑ মারাÍক অস্বাস্থ্যকর ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্বলিত দুঃসহ, ভয়াবহ জীবনসংহারী ধুলা আর ধোঁয়া! বহু আগেই ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার।
এখন মহামারি থেকেও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে বাংলাদেশের বায়ুদূষণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে তাকালে চোখ বেয়ে পানি চলে আসে। সাধারণ মানুষের তো আর দুর্নীতি ও ঘুষের টাকা নেই। অন্যের দারে দারে চাইবার উপায় নেই। তাই সরকারের দৃষ্টি আকার্ষণ করে বলছি, দেশের উন্নয়নের সাথে আগে দেশের দিনমজুর ও গরিব অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাকান। যেকোনোভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে নিম্নআয়ের মানুষগুলোকে বাঁচান।
দূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের প্রথম স্থান হওয়ার এ অর্জনটা আমাদের অনেকগুলো মন্ত্রণালয়ের চরম আন্তরিক প্রচেষ্টার ফল! আমাদের খোঁড়াখুড়ি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদ্যুৎ, ওয়াসা, ডেসা আমাদের দুই সিটির দুই নগর পিতা আছেন তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলছেন; আর সব চেয়ে বেশি আমাদের সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের, যারা ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, লেগুনা, পিকআপ দিয়ে শহরের জন্য আকাশ ভরা ‘তারা’ করে রেখেছেন। এদের সবাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেয়া যেতে পারে।
দূষণে শতবার শীর্ষে থাকা কি উন্নয়নের জোয়ারের ‘সাইড ইফেক্ট’! সাফল্যের শ্রীবৃদ্ধির, তুঙ্গে আমরা। এরপরও যারা বলবে উন্নয়ন হয়নি, জনগণ তাদের চিনে রাখবে! আমরা তো উন্নয়নের রোল মডেল, ডিজিটাল বাংলাদেশের রোল মডেলের। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। রাতে কেবলই মশার আলতো ছোঁয়া, দিনে ধুলো-বালি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, বাহ্ কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
কাজলা-গুলিস্তান টু চাঁনখারপুল ফ্লাইওভার চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। এখন ২০২৪। এত বছর পরেও ফ্লাইওভারের নিচে যে ধুলা-বালি সেগুলো অপসারণ করা হয়নি। উল্টো বেড়ার মতো করে এগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে। প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করে আর ধুলা-কুয়াশার মতো উড়ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গাড়ি, কলকারখানার ধোঁয়ায় মাঝে মাঝে মনে হয় যেন কুয়াশার আস্তরণে শহর ঢাকা পড়েছে। কর্তৃপক্ষের কোন খেয়াল আছে কি এসবের প্রতি?
আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ, মাছ-ফল-সব্জিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এরকম কত কিছুর ঝুঁকি নিয়েই আমরা চলছি! এটি সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। সব যায়গায় সমস্যা! এসব দেখারও যেন কেউ নেই! অনুধাবন, বা অনুভাবন করারও যেন কেউ নেই! হায়রে দেশ! হায়রে মানুষ! শুধু কি বায়ুদূষণ? বর্তমানে বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ডের মধ্যে অনেক কিছুতেই শীর্ষে। বিশ্বের মধ্যে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানোতে আমরাই বিশ্বে প্রথম। এছাড়া ভাষা দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ, শিক্ষা দূষণ, যানজটের দূষণ কত কি? সাথে রাজনীতি, নির্বাচন, প্রশাসনের কথা নাই থাকলো। দূষণ, দুর্নীতি, ধর্ষণ যেনো দেশব্যাপী উইরা উইরা ঘুরে বেরোচ্ছে! শুধু বায়ু দূষিত না, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষগুলো দুর্নীতির দূষণে দূষিত। আর সার্বিক দুর্নীতির সরল সমীকরণ হল এই বায়ুদূষণ! কারণ আমাদের মাথাই এখন দূষিত; চুরি, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট, ফাঁকিবাজি, লুটপাট মোট কথা ভেজাল, দূষণ ছাড়া আমরা কিছুই বুঝিনা, তা সে যেভাবেই হোক হতে হবে, রডের বদলে বাঁশ দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে হোক বা হাঁটুপানিতে ঢালাই ঢেলে হোক!
সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায় দেশের শিক্ষাঙ্গনে নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু ঢাকার ভিকারুননিসা, চট্টগ্রাম কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনা নিত্যদিনই ঘটছে। পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেওয়া, চাকরির প্রলোভন দেখানো, বিশেষ কোনো সুবিধা আদায়ের টোপে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকরা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠছেন। পরিবার, সমাজ কিংবা নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অধিকাংশ ঘটনাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। ফলে জীবনের বিষাদময় এসব ঘটনা বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক নারী শিক্ষার্থী।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় শিশু ও নারীদের দূষণজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। বাড়ন্ত শিশুর ফুসফুস ও স্নায়ুর বিকাশের জন্য দূষিত বাতাস খুবই ক্ষতিকর। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, তার বেশির ভাগেরই কারণ বায়ুদূষণ। শিশুরা তুলনামূলকভাবে বড়দের চেয়ে বেশি দ্রুত শ্বাস নেওয়ায় তাদের ওজনের তুলনায় বেশি বাতাস গ্রহণ করে। আর দূষিত বাতাস বেশি গ্রহণ করা মানে, বেশি বেশি জীবাণু শরীরে ঢুকে পড়া।
শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম থাকে এবং এই পাঁচ মাসে সারা বছরের ৬০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। বাকি সাত মাসে সারা বছরের ৪০ ভাগ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এজন্য শুষ্ক মৌসুমে যদি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে মানুষকে বায়ুদূষণ থেকে বাঁচা সম্ভব। এছাড়া আমাদের যে জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশন ও মেট্রোলজিক্যাল কন্ডিশন, সেখানে বছরে সাত মাসই বৃষ্টিপাতের কারণে বায়ুদূষণের পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যায়। বাকি চার মাসের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলার কি খুবই প্রয়োজন? যদি ফিটনেস আছে এমন গাড়ি রাখা হয় এবং ভালোমানের গণপরিবহন চালু করা যায়, এক্ষেত্রে যে ১৫ ভাগ বায়ুদূষণ হয় সেটি অনেক কমে আসবে।
সরকারকে প্রথমে মানুষের জীবনকে মূল্যায়ন করাটা শিখতে হবে এবং মানুষের জীবনের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তারপর উন্নয়নকে ঢেলে সাজাতে হবে। মানুষের কাছে জবাবদিহিতার সংস্কৃতিতে কিছুটা হলেও ফেরত আসতে হবে। আর যেসব বায়ুদূষণকারী শিল্প প্রকল্প উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকল্প আছে সরকারকে অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে বলে আমরা মনে করছি।
বাস্তবতা হলোÑ আমরাই নোংরা তাই আমাদের দেশের পরিবেশও নোংরা। আমরা যে একটা শৃঙ্খলাবিহীন জাতি। এর জন্য দায়ী আমরাই, কারণ আমরা নির্দিষ্ট স্থানে কখনো ময়লা আবর্জনা ফেলি না। আসলেই আমরা নান্দনিক রুচি জ্ঞানহীন, অপরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ অসচেতন। দূষণে শীর্ষ অবস্থানের দায় কী শুধুই সরকারের! যত্র-তত্র পলিথিন, আবর্জনা কি আমরা ফেলি না! আপনার হাতে এখন যে আবর্জনার প্যাকেট বা পরিত্যক্ত বস্তুটি আছে তা কোথায় ফেলবেন, ভেবেছেন কী?
ঢাকা কেন বারবার দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সিটি কর্পোরেশন, সড়ক পরিবহন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? সরকারেরও সুমতি হবে না? বাংলাদেশের সরকারি প্রায় সব অফিসের কর্তারা বসে বসে বেতন নিতে আগ্রহী। কাজ করতে আগ্রহী নয়। বায়ুদূষণ রোধে অনেকগুলো সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
সুনির্দিষ্ট এবং সুচারু পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায় না। ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের কি পরিকল্পনা আছে তা আমাদের বলুন। আর জানা না থাকলে শুধু আমলাবেষ্টিত না থেকে এনভায়রনমেন্টাল এবং আরবান এক্সপার্টদের নিয়ে বসুন। বায়ুদূষণ রোধের উপায় বের করুন!
শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, ফ্যাক্টরি, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখতে হবে। সর্বসাধারণেরও সচেতন হওয়া জরুরি। রাস্তায় যেসব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়, সেগুলোই জীবাণু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা সৃঙ্খল না হবো, ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এজন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন; যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশেই সম্ভব সমাজ, দেশ ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো।
[লেখক : প্রাবন্ধিক]