এম এ কবীর
শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে বিশ্বের নির্যাতিতরা। প্রতিবাদ করছে ফিলিস্তিনিরাও, কিন্তু তাদের প্রতিবাদের ধরন একটু ভিন্ন। ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণ নিজেদের নবজাতক কন্যা শিশুদের নাম ‘শিরিন’ রেখে সাংবাদিক হত্যার এক অভিনব প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম আল আরাবি জানায়, এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের অন্তত তিনটি নবজাতক কন্যা শিশুর নাম ‘শিরিন’ রাখা হয়েছে। শিরিন আবু আকলেহর সাহসিকতা ও নির্যাতিতদের প্রতি তার সহযোগিতার স্মৃতি ধরে রাখতে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদের এই পদ্ধতি বেছে নেন। নাবলুসে বসবাসকারী এক বাবার নাম জামাল হারবি ইমরান। তিনি তার সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়ের নাম রেখেছেন শিরিন। আনাদোলুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান বলেন, ‘সাংবাদিক শিরিন নিহত হওয়ার খবর শুনে আমাদের ঘুম ভাঙে। এর ঠিক ঘণ্টা দুয়েক পর স্থানীয় সরকারি একটি হাসপাতালে আমার স্ত্রী এক কন্যা শিশুর জন্ম দেন। তখন-ই আমি আমার মেয়ের নাম শিরিন রাখব বলে স্থির করি।’ জামাল হারবি আশা করছেন, তার মেয়ে ‘শিরিন’ও সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর মতো হবে।
পূর্ব নাবলুসের বালাতা শরণার্থী শিবিরে থাকেন ছায়ের দুআইকাত। শিরিন নিহত হওয়ার দিনে তিনিও এক কন্যা শিশুর বাবা হন। হাসপাতালে তার স্ত্রীর কোলের শিশুটির নাম রাখেন ‘শিরিন’। দুআইকাত বলেন, ‘শিরিন আবু আকলেহর কণ্ঠ শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। সেই ২০০০ সালের ইন্তেফাদা থেকে আমরা তার নিয়মিত পাঠক ও দর্শক। আমি চাই, আমার মেয়েও সাংবাদিকতা করুক। তিনি জানান, মেয়ে ‘শিরিন’কে সাংবাদিকতা শিখতে উৎসাহ দেবেন তিনি।’ একইভাবে ফিলিস্তিনে আরেকটি নবজাতকের নাম ‘শিরিন’ রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ‘শাবাকাতুল কুদস আল ইখবারিয়্যাহ’ নামে দেশটির একটি সংবাদমাধ্যম। শাবাকাহ জানায়, রামাল্লাহর একটি সড়কের নামকরণও করা হয়েছে ‘শিরিন আবু আকলেহ’র নামে।
আরববিশ্বের বিখ্যাত সাংবাদিকদের একজন শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকান্ড শুধু তার বন্ধু ও অনুরাগীদের জন্যই দুঃখজনক ও বিপর্যয়কর আঘাত নয়, বরং এটি এই ভয়ংকর বার্তাও দেয় যে পবিত্র ভূমিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রমণের মুখে রয়েছে। আবু আকলেহ পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অভিযান কাভার করতে যাওয়া একদল সাংবাদিকের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের মতে, ইসরায়েলি সেনারা তার মাথায় গুলি করে। ওই সময় তিনি এবং তার প্রযোজক (যাকে পেছনে গুলি করা হয়) দুজনই ‘প্রেস ভেস্ট’ পরা ছিলেন। তার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, ইসরায়েলি সেনারা ‘ঠান্ডা মাথায়’ আবু আকলেহকে গুলি করেছে।
অভিযোগের ব্যাপারে ইসরায়েলও স্বভাবসুলভ জবাব দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে দেশটি দাবি করে যে শিরিনকে গুলি করা ব্যক্তি ছিল একজন ফিলিস্তিনি। কিন্তু এই দাবি অসার প্রমাণিত। এখন ইসরায়েল বলছে, তাদের সেনারা ‘দুর্ঘটনাবশত’ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের ভাবনাটা এমন যে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করতে হবে অথবা এই হত্যা নির্দেশিত ছিল এই দোষারোপ করার সুযোগ নেই। এই যুক্তিতর্ক এখন আদালতে নয়, বরং জনতার আদালতে উঠছে। আবু আকলেহ একজন আমেরিকান নাগরিক ছিলেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৪৭ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যার জন্য ইসরায়েল কখনো কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি। এবার আবু আকলেহের হত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যেতে চাচ্ছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এ ছাড়া তাকে হত্যার আগে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস একই আদালতে দাখিল করা এক অভিযোগে দাবি করেছে যে ইসরায়েল যেভাবে গণমাধ্যমকে লক্ষ্য বানিয়েছে, তা যুদ্ধাপরাধের শামিল।
গত মে মাসে ইসরায়েল গাজা শহরের একটি মিডিয়া ভবনে বোমাবর্ষণ করে। ভবনটিতে ফিলিস্তিনি গণমাধ্যম ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপির) কার্যালয় ছিল। তখন ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে ভবনটি হামাস ব্যবহার করছে। গত জুনে ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের দখলকৃত অঞ্চলে অন্তত ১৩ শিশুসহ ৭৬ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনে নাকবা দিবস (ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় সৃষ্ট বিপর্যয় স্মরণ দিবস) পালন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এদিন নবগঠিত রাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে তাদের মাতৃভূমি হারানোর শোক প্রকাশ করে।
শিরিন আবু আকলেহকে এখন পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। শুধু আরব নয়, বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে গেছে তার নাম। কারণ, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের নানা বিষয় এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে আসছিলেন এই সাংবাদিক। কাজের মধ্যেই গত ১১ মে-২০২২ পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ৫১ বছর বয়সেই নিভে যায় তার প্রাণ প্রদীপ। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভুত আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শিরিন কীভাবে ওই অঞ্চলে সাংবাদিকতায় ইতিহাস হয়ে উঠলেন, তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। ১৯৯৭ সালে তার শুরু। কাতারের দোহাভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরা শুরুর পরের বছর থেকেই নিজের ইতিহাস নিজেই তৈরি করেছিলেন সাংবাদিক শিরিন। আরব নারীদের একটি প্রজন্মের কাছে সাংবাদিকতার চালিকাশক্তি ছিলেন তিনি। শিরিনই প্রথম নারী সংবাদকর্মী, যাকে তারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন, তাকে ‘আইকন’ মেনে নিজেদের তার আদলে তৈরির কথা ভেবেছেন।
১১ মে ঘটনার দিন অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিরিন; পরনের পোশাকে ‘ প্রেস’ লেখাও ছিল, হঠাৎ একটি গুলি এসে তার গায়ে লাগে। প্রাণ যায় শিরিনের। আল-জাজিরার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এটা ইসরায়েলি বাহিনীর ‘ঠান্ডা মাথায় খুন’। ঘটনার পর শোক, ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিরিনকে আপনজন ভাবা ফিলিস্তিনিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে তাকে স্মরণ করতে শুরু করেন হাজার হাজার মানুষ। তারা মনে করতেন, তিনি ‘তাদের কথা জানেন, তাদের কথা বলেন’। পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তার ছবি নিয়ে টানান হয়েছে বিশাল বিলবোর্ড। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকে স্মরণ করছেন অনেকে। তবে সব ছাপিয়ে শিরিন একটি শিরোনাম অর্জন করেছেন কাজ এবং জীবন দিয়ে, সেটি হলো ‘সাংবাদিক’।
অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, শিরিনের আত্মবিশ্বাস ও হাসিমুখ সবার থেকে তাকে আলাদা করতো। বিশেষ করে ২০০০ সালে মুক্তির আন্দোলনের সময় পশ্চিম তীরের প্রধান শহরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর বড় ধরনের হামলার সংবাদ প্রকাশের জন্য অনেক ফিলিস্তিনি শিরিনকে স্মরণ করেন গভীরভাবে। সেই উত্তরের শহরেই ইসরায়েলি অভিযানের খবর সংগ্রহে গিয়ে প্রাণ হারালেন শিরিন। এখন তার মৃত্যুর খবরটাই সবচেয়ে বড়। যে মৃত্যু ফিলিস্তিন, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, শোকাচ্ছন্ন করেছে। তার সহকর্মীরা মনে করেন, শিরিনের মরদেহের কাঠের কফিনটিতে গাঢ় সাদা অক্ষরে ‘প্রেস’ লেখা নীল দেহের বর্মটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের শক্তি এবং বেদনার স্মারক। আরব সাংবাদিক ও লেখক মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, ভয়াবহ পরিস্থিতি, এমনকি রক্তাক্ত স্থানেও যখন থাকতেন শিরিন, তখনও শান্ত ও ধীরস্থির থাকতেন। এখন শিরিন নেই- তাই এ ধরনের অনেক খবর হারিয়ে যাবে।
ইসরায়েলি দখলদারিত্বের নির্মম শিকার শিরিন। কে বা কোন সৈন্যটি তাকে গুলি করেছে, সেই বিবেচনা এখানে অর্থহীন। ভোরবেলা তাকে যদি খুন করতে না পারত, তাহলে বিকেলবেলায় শিরিনের বাড়ি আক্রমণ করতে যেত ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী। আবু আকলেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকার্ত মানুষ পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছে। কেন? কারণ, তারা এমনই।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]
এম এ কবীর
শুক্রবার, ২৭ মে ২০২২
শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে বিশ্বের নির্যাতিতরা। প্রতিবাদ করছে ফিলিস্তিনিরাও, কিন্তু তাদের প্রতিবাদের ধরন একটু ভিন্ন। ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণ নিজেদের নবজাতক কন্যা শিশুদের নাম ‘শিরিন’ রেখে সাংবাদিক হত্যার এক অভিনব প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম আল আরাবি জানায়, এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের অন্তত তিনটি নবজাতক কন্যা শিশুর নাম ‘শিরিন’ রাখা হয়েছে। শিরিন আবু আকলেহর সাহসিকতা ও নির্যাতিতদের প্রতি তার সহযোগিতার স্মৃতি ধরে রাখতে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদের এই পদ্ধতি বেছে নেন। নাবলুসে বসবাসকারী এক বাবার নাম জামাল হারবি ইমরান। তিনি তার সদ্য ভূমিষ্ঠ মেয়ের নাম রেখেছেন শিরিন। আনাদোলুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইমরান বলেন, ‘সাংবাদিক শিরিন নিহত হওয়ার খবর শুনে আমাদের ঘুম ভাঙে। এর ঠিক ঘণ্টা দুয়েক পর স্থানীয় সরকারি একটি হাসপাতালে আমার স্ত্রী এক কন্যা শিশুর জন্ম দেন। তখন-ই আমি আমার মেয়ের নাম শিরিন রাখব বলে স্থির করি।’ জামাল হারবি আশা করছেন, তার মেয়ে ‘শিরিন’ও সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর মতো হবে।
পূর্ব নাবলুসের বালাতা শরণার্থী শিবিরে থাকেন ছায়ের দুআইকাত। শিরিন নিহত হওয়ার দিনে তিনিও এক কন্যা শিশুর বাবা হন। হাসপাতালে তার স্ত্রীর কোলের শিশুটির নাম রাখেন ‘শিরিন’। দুআইকাত বলেন, ‘শিরিন আবু আকলেহর কণ্ঠ শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। সেই ২০০০ সালের ইন্তেফাদা থেকে আমরা তার নিয়মিত পাঠক ও দর্শক। আমি চাই, আমার মেয়েও সাংবাদিকতা করুক। তিনি জানান, মেয়ে ‘শিরিন’কে সাংবাদিকতা শিখতে উৎসাহ দেবেন তিনি।’ একইভাবে ফিলিস্তিনে আরেকটি নবজাতকের নাম ‘শিরিন’ রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ‘শাবাকাতুল কুদস আল ইখবারিয়্যাহ’ নামে দেশটির একটি সংবাদমাধ্যম। শাবাকাহ জানায়, রামাল্লাহর একটি সড়কের নামকরণও করা হয়েছে ‘শিরিন আবু আকলেহ’র নামে।
আরববিশ্বের বিখ্যাত সাংবাদিকদের একজন শিরিন আবু আকলেহকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকান্ড শুধু তার বন্ধু ও অনুরাগীদের জন্যই দুঃখজনক ও বিপর্যয়কর আঘাত নয়, বরং এটি এই ভয়ংকর বার্তাও দেয় যে পবিত্র ভূমিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রমণের মুখে রয়েছে। আবু আকলেহ পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অভিযান কাভার করতে যাওয়া একদল সাংবাদিকের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের মতে, ইসরায়েলি সেনারা তার মাথায় গুলি করে। ওই সময় তিনি এবং তার প্রযোজক (যাকে পেছনে গুলি করা হয়) দুজনই ‘প্রেস ভেস্ট’ পরা ছিলেন। তার নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, ইসরায়েলি সেনারা ‘ঠান্ডা মাথায়’ আবু আকলেহকে গুলি করেছে।
অভিযোগের ব্যাপারে ইসরায়েলও স্বভাবসুলভ জবাব দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে দেশটি দাবি করে যে শিরিনকে গুলি করা ব্যক্তি ছিল একজন ফিলিস্তিনি। কিন্তু এই দাবি অসার প্রমাণিত। এখন ইসরায়েল বলছে, তাদের সেনারা ‘দুর্ঘটনাবশত’ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। ইসরায়েলের ভাবনাটা এমন যে সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ করতে হবে অথবা এই হত্যা নির্দেশিত ছিল এই দোষারোপ করার সুযোগ নেই। এই যুক্তিতর্ক এখন আদালতে নয়, বরং জনতার আদালতে উঠছে। আবু আকলেহ একজন আমেরিকান নাগরিক ছিলেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এই ঘটনা তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৪৭ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের হত্যার জন্য ইসরায়েল কখনো কাউকে বিচারের আওতায় আনেনি। এবার আবু আকলেহের হত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যেতে চাচ্ছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এ ছাড়া তাকে হত্যার আগে ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস একই আদালতে দাখিল করা এক অভিযোগে দাবি করেছে যে ইসরায়েল যেভাবে গণমাধ্যমকে লক্ষ্য বানিয়েছে, তা যুদ্ধাপরাধের শামিল।
গত মে মাসে ইসরায়েল গাজা শহরের একটি মিডিয়া ভবনে বোমাবর্ষণ করে। ভবনটিতে ফিলিস্তিনি গণমাধ্যম ও অ্যাসোসিয়েট প্রেসের (এপির) কার্যালয় ছিল। তখন ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে ভবনটি হামাস ব্যবহার করছে। গত জুনে ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের দখলকৃত অঞ্চলে অন্তত ১৩ শিশুসহ ৭৬ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনে নাকবা দিবস (ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় সৃষ্ট বিপর্যয় স্মরণ দিবস) পালন করা হয়। ফিলিস্তিনিরা এদিন নবগঠিত রাষ্ট্র ইসরায়েলের কাছে তাদের মাতৃভূমি হারানোর শোক প্রকাশ করে।
শিরিন আবু আকলেহকে এখন পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। শুধু আরব নয়, বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে গেছে তার নাম। কারণ, খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে তাকে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের নানা বিষয় এবং মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে আসছিলেন এই সাংবাদিক। কাজের মধ্যেই গত ১১ মে-২০২২ পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ৫১ বছর বয়সেই নিভে যায় তার প্রাণ প্রদীপ। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভুত আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শিরিন কীভাবে ওই অঞ্চলে সাংবাদিকতায় ইতিহাস হয়ে উঠলেন, তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। ১৯৯৭ সালে তার শুরু। কাতারের দোহাভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরা শুরুর পরের বছর থেকেই নিজের ইতিহাস নিজেই তৈরি করেছিলেন সাংবাদিক শিরিন। আরব নারীদের একটি প্রজন্মের কাছে সাংবাদিকতার চালিকাশক্তি ছিলেন তিনি। শিরিনই প্রথম নারী সংবাদকর্মী, যাকে তারা টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছেন, তাকে ‘আইকন’ মেনে নিজেদের তার আদলে তৈরির কথা ভেবেছেন।
১১ মে ঘটনার দিন অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শিরিন; পরনের পোশাকে ‘ প্রেস’ লেখাও ছিল, হঠাৎ একটি গুলি এসে তার গায়ে লাগে। প্রাণ যায় শিরিনের। আল-জাজিরার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এটা ইসরায়েলি বাহিনীর ‘ঠান্ডা মাথায় খুন’। ঘটনার পর শোক, ক্ষোভ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিরিনকে আপনজন ভাবা ফিলিস্তিনিরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমজুড়ে তাকে স্মরণ করতে শুরু করেন হাজার হাজার মানুষ। তারা মনে করতেন, তিনি ‘তাদের কথা জানেন, তাদের কথা বলেন’। পশ্চিম তীরের রামাল্লায় তার ছবি নিয়ে টানান হয়েছে বিশাল বিলবোর্ড। মোমবাতি জ্বালিয়ে তাকে স্মরণ করছেন অনেকে। তবে সব ছাপিয়ে শিরিন একটি শিরোনাম অর্জন করেছেন কাজ এবং জীবন দিয়ে, সেটি হলো ‘সাংবাদিক’।
অনেক ফিলিস্তিনি মনে করেন, শিরিনের আত্মবিশ্বাস ও হাসিমুখ সবার থেকে তাকে আলাদা করতো। বিশেষ করে ২০০০ সালে মুক্তির আন্দোলনের সময় পশ্চিম তীরের প্রধান শহরগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর বড় ধরনের হামলার সংবাদ প্রকাশের জন্য অনেক ফিলিস্তিনি শিরিনকে স্মরণ করেন গভীরভাবে। সেই উত্তরের শহরেই ইসরায়েলি অভিযানের খবর সংগ্রহে গিয়ে প্রাণ হারালেন শিরিন। এখন তার মৃত্যুর খবরটাই সবচেয়ে বড়। যে মৃত্যু ফিলিস্তিন, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে, শোকাচ্ছন্ন করেছে। তার সহকর্মীরা মনে করেন, শিরিনের মরদেহের কাঠের কফিনটিতে গাঢ় সাদা অক্ষরে ‘প্রেস’ লেখা নীল দেহের বর্মটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এবং অন্যান্য যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের শক্তি এবং বেদনার স্মারক। আরব সাংবাদিক ও লেখক মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, ভয়াবহ পরিস্থিতি, এমনকি রক্তাক্ত স্থানেও যখন থাকতেন শিরিন, তখনও শান্ত ও ধীরস্থির থাকতেন। এখন শিরিন নেই- তাই এ ধরনের অনেক খবর হারিয়ে যাবে।
ইসরায়েলি দখলদারিত্বের নির্মম শিকার শিরিন। কে বা কোন সৈন্যটি তাকে গুলি করেছে, সেই বিবেচনা এখানে অর্থহীন। ভোরবেলা তাকে যদি খুন করতে না পারত, তাহলে বিকেলবেলায় শিরিনের বাড়ি আক্রমণ করতে যেত ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী। আবু আকলেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোকার্ত মানুষ পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছে। কেন? কারণ, তারা এমনই।
[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]