ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না। তবে জাতীয় উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি শিক্ষার্থী উদার ও মানবিক হওয়ার সুযোগ পায়। একজন ভালো শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বিনয়ী, সৎ, বুদ্ধিমান, দায়িত্বশীল, সময়নিষ্ঠ ও সৃজনশীল হতে হবে। তার মধ্যে সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ ও আত্মবিশ্বাস থাকবে। লেখাপড়ায় মনোযোগী হবে, অন্যের মতামতকে সম্মান করবে এবং বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজের ও অন্যদের কল্যাণের কথা সচেতনভাবে ভাববে। আমাদের দেশের চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত, যা বিশ্বের বহু দেশের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি। এসব শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। এরাই আমাদের আলোর দিশারী। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে শেষ হওয়া এ শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতায় সুনিপুণভাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন। শিশুর বয়স, মেধা, অভিরুচির ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ গবেষক দ্বারা তৈরি এসব শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম। আকর্ষণীয় এবং সহজবোধ্য পাঠ্যক্রম শিশু শিক্ষার্থীদের নান্দনিক মানস গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বয়সের ধাপে ধাপে তাদের শেখা পছন্দ ও রুচির পরিবর্তন ঘটে।
প্রত্যেক শিশুর মধ্যে জন্মগতভাবে কিছু প্রবণতা থাকে। উন্নত বিশ্বে শিশুর প্রবণতাগুলো গভীরভাবে প্রর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার জন্য উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা করে থাকে; কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলে শিশুর প্রবণতাগুলো কাজে লাগিয়ে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। যদি শিক্ষক-শিক্ষক সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে থাকেন, তাহলে শিশুরা সত্যিকারের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। আর এই আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আসে আত্মনির্ভরশীলতা। শিশুরা গৃহে সাধারণত মাতার ওপর নির্ভরশীল থাকে। বিদ্যালয়ে এসেও তারা যদি শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল থাকে তবে তারা ভবিষ্যতে সার্থক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। তাই বিদ্যালয়ের সহশিক্ষা ক্রমিক কার্যাবলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। সহপাঠ্য ক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার মধ্যে বৈচিত্র্য আসে। ফলে তার পড়ালেখার একঘেয়েমি দূর হয় এবং তার বিদ্যালয়ের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারলে বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়। খেলার মাঠের নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন সভার নিয়ম-কানুন বা এরূপ অন্যান্য অনুষ্ঠানের নিয়ম-কানুন অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সহপাঠ্যক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালিত হয়। ফলে শিশুর দৈহিক বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে আবার বক্তৃতা, বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে।
পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিষয়ে অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করাই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বা সহশিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মূল সিলেবাস কিংবা পুঁথিগত বিষয়ের বাইরে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতার জায়গাগুলোয় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে কাজগুলো করে থাকেন সেগুলোই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস। যে কোন কাজ যা আপনার বিশেষ কোন গুণের প্রকাশ ঘটায় এবং সরাসরি পড়াশোনার সাথে সম্পর্কিত নয়, তাই সহশিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন বা ক্লাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। যেমন- বিতর্ক, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাটক, গান, কুইজ, তবলা, বাঁশি বাজানোর চর্চা, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, সিনেক্লাব, ম্যাথ বা ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, বইপড়া ক্লাব, বিজ্ঞানচর্চা ক্লাব, দেয়ালিকা বের করা ইত্যাদি। সাক্ষরতা অভিযান, স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন, রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ইত্যাদি কর্মসূচিও পরিচালনা করে থাকে শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো। স্কুলপর্যায়েই রয়েছে স্কাউট, গার্লস গাইড। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবা ছাড়াও আকস্মিক ও জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী সময়ের ত্রাণ ও সেবা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া যদি আপনি পারিবারিক কোন দায়িত্ব পালন করেন সেটাও আপনার এক্সট্রা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। মোটকথা পড়াশোনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয় কিন্তু দক্ষতার প্রমাণ হিসবে কাজ করবে- এমন যে কোনো কিছুই এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বাড়াতেও সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য, সহনশীল, পরমতসহিষ্ণু, ধর্মনিরেপক্ষ ও উদার মানসিকতার জন্য সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সহপাঠ কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে পরমতসহিষ্ণুতা, নানা শ্রেণি, নানা মতের শিক্ষার্থীদের ঐকমত্য। যে প্রতিযোগিতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে ওঠে, সেখানে সহমর্মিতা, অন্যের মতকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ থাকে না। ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে- এটাই অভিভাবকের চাওয়া। শিক্ষার্থীর চাওয়া-পাওয়াটা গৌণ। এত চাপের মধ্যে সৃজনশীলতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চার সময় কোথায়। এমন শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ হতে পারে সৃজনশীলতার বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার চমৎকার একটি মঞ্চ।
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি একদিকে মেধাকে শানিত করে, অন্যদিকে অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করার সুযোগ তেরি করে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্য বইপত্রের মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে একজন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, সমাজ-রাষ্ট্র-নিজের বাস্তব জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার সম্ভবনা অনেক বেশি রয়েছে। এছাড়া আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি প্রয়োজন এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি, যা আপনাকে স্বপ্ন পূরণে পাথেয় হতে পারে। একজন শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে তার নানা দক্ষতা সম্পর্কে জানা যায়। তাই একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও সমগুরুত্বপূর্ণ। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, অভিজ্ঞতা লাভ, সামাজিকীকরণ, চাকরির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা, দলগতভাবে কাজের শিক্ষা অর্জন, সামাজিক সুযোগগুলো উন্মুক্ত হওয়া, আত্মসম্মান বৃদ্ধি, নিজের আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ অর্জন, একাডেমিক পারফরমেন্স উন্নত করা, সময়ের সদ্ব্যবহার, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ ও সুবিধা বা উপকারিতা অর্জিত হয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে।
পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে। তাদের ভেতরে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। একজন শিক্ষার্থী যখন তার আগ্রহ ও পছন্দের কাজের সাথে যুক্ত থাকে, সেখান থেকে প্রচুর আনন্দ ও মানসিক শক্তি আসে, যা তাকে তার জীবনের অন্যান্য মানসিক চাপগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। তাছাড়া এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত থাকে, ফলে যখন একজন শিক্ষার্থী কোনো বিপদ বা মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়, সহজেই অন্যদের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য এ ধরনের সামাজিক সহযোগিতা বা পারস্পরিক সহযোগিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম যখন বিকাশমূলক না হয়ে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক হয় তখন তা খুব বেশি সহযোগিতা করে না বরং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেইসাথে টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব কার্যক্রমের অতিরিক্ত চাপ যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, বিশ্রাম বা পারিবারিক বন্ধন ও দায়িত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তা একজন শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ আমাদের মানসিক প্রশান্তি এ সবকিছুর ভারসাম্যের ওপরও নির্ভর করে।
যে সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতে জানে, ধ্বংসের ভয়াবহতা তাকে আকৃষ্ট করে না। দলগত কাজের শক্তি যে বুঝতে শেখে, বিচ্ছিন্নতাবাদ তাকে বিভ্রান্ত করে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের চর্চা তরুণদের দেয় সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্র, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার শিক্ষা। তাই হিংসা-বিদ্বেষ আর যুদ্ধ-বিগ্রহে যখন প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পৃথিবী, তখন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা ভীষণ প্রয়োজন। সর্বোপরি বলা যায়, সফল ও সার্থক মানব জীবন গঠনে সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘হাওয়া খেলে যেমন পেট ভরে না, কিন্তু খাদ্য হজমের জন্য হাওয়ার প্রয়োজন’- ঠিক তেমনি শিক্ষাকে প্রকৃতভাবে অর্জন এবং জীবন উপযোগী করতে হলে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বড়ই দরকার। এ কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা ও জীবন মান গঠনে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষাক্রমিক জ্ঞান প্রদান করা আবশ্যক- এ লক্ষ্যেই সবার কাজ করা উচিত।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
শুক্রবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২
শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না। তবে জাতীয় উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রাথমিক শিক্ষা। মানসম্মত শিক্ষা জাতির ভবিষ্যৎ গঠন ও উন্নয়নের জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি শিক্ষার্থী উদার ও মানবিক হওয়ার সুযোগ পায়। একজন ভালো শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বিনয়ী, সৎ, বুদ্ধিমান, দায়িত্বশীল, সময়নিষ্ঠ ও সৃজনশীল হতে হবে। তার মধ্যে সহমর্মিতা, শৃঙ্খলাবোধ ও আত্মবিশ্বাস থাকবে। লেখাপড়ায় মনোযোগী হবে, অন্যের মতামতকে সম্মান করবে এবং বিশ্ব নাগরিক হিসেবে নিজের ও অন্যদের কল্যাণের কথা সচেতনভাবে ভাববে। আমাদের দেশের চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত, যা বিশ্বের বহু দেশের মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি। এসব শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কর্ণধার। এরাই আমাদের আলোর দিশারী। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে শেষ হওয়া এ শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতায় সুনিপুণভাবে সন্নিবেশ করা হয়েছে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন। শিশুর বয়স, মেধা, অভিরুচির ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞ গবেষক দ্বারা তৈরি এসব শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম। আকর্ষণীয় এবং সহজবোধ্য পাঠ্যক্রম শিশু শিক্ষার্থীদের নান্দনিক মানস গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বয়সের ধাপে ধাপে তাদের শেখা পছন্দ ও রুচির পরিবর্তন ঘটে।
প্রত্যেক শিশুর মধ্যে জন্মগতভাবে কিছু প্রবণতা থাকে। উন্নত বিশ্বে শিশুর প্রবণতাগুলো গভীরভাবে প্রর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার জন্য উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা করে থাকে; কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। একজন শিক্ষক ইচ্ছা করলে শিশুর প্রবণতাগুলো কাজে লাগিয়ে শিশুর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে। যদি শিক্ষক-শিক্ষক সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে থাকেন, তাহলে শিশুরা সত্যিকারের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। সহপাঠ্যক্রমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা যায়। আর এই আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে আসে আত্মনির্ভরশীলতা। শিশুরা গৃহে সাধারণত মাতার ওপর নির্ভরশীল থাকে। বিদ্যালয়ে এসেও তারা যদি শিক্ষকদের ওপর নির্ভরশীল থাকে তবে তারা ভবিষ্যতে সার্থক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। তাই বিদ্যালয়ের সহশিক্ষা ক্রমিক কার্যাবলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে। সহপাঠ্য ক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর শিক্ষার মধ্যে বৈচিত্র্য আসে। ফলে তার পড়ালেখার একঘেয়েমি দূর হয় এবং তার বিদ্যালয়ের প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারলে বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়। খেলার মাঠের নিয়ম-কানুন, বিভিন্ন সভার নিয়ম-কানুন বা এরূপ অন্যান্য অনুষ্ঠানের নিয়ম-কানুন অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সহপাঠ্যক্রমিক কাজের মাধ্যমে শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ সাধিত হয়। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চালিত হয়। ফলে শিশুর দৈহিক বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে আবার বক্তৃতা, বিতর্ক ইত্যাদির মাধ্যমে শিশুর মানসিক বিকাশ পূর্ণতা লাভ করে।
পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের পছন্দের বিষয়ে অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করাই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস বা সহশিক্ষা কার্যক্রমের লক্ষ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মূল সিলেবাস কিংবা পুঁথিগত বিষয়ের বাইরে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতার জায়গাগুলোয় উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যে কাজগুলো করে থাকেন সেগুলোই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস। যে কোন কাজ যা আপনার বিশেষ কোন গুণের প্রকাশ ঘটায় এবং সরাসরি পড়াশোনার সাথে সম্পর্কিত নয়, তাই সহশিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বিভিন্ন ধরনের সংগঠন বা ক্লাব রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত। যেমন- বিতর্ক, আবৃত্তি, ছবি আঁকা, নাটক, গান, কুইজ, তবলা, বাঁশি বাজানোর চর্চা, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, সিনেক্লাব, ম্যাথ বা ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, স্বেচ্ছাসেবকের কাজ, বইপড়া ক্লাব, বিজ্ঞানচর্চা ক্লাব, দেয়ালিকা বের করা ইত্যাদি। সাক্ষরতা অভিযান, স্বাস্থ্য সপ্তাহ পালন, রক্তদান কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ইত্যাদি কর্মসূচিও পরিচালনা করে থাকে শিক্ষার্থীদের সংগঠনগুলো। স্কুলপর্যায়েই রয়েছে স্কাউট, গার্লস গাইড। এছাড়া বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, যারা নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবা ছাড়াও আকস্মিক ও জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস পরবর্তী সময়ের ত্রাণ ও সেবা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া যদি আপনি পারিবারিক কোন দায়িত্ব পালন করেন সেটাও আপনার এক্সট্রা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। মোটকথা পড়াশোনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয় কিন্তু দক্ষতার প্রমাণ হিসবে কাজ করবে- এমন যে কোনো কিছুই এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বাড়াতেও সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষার পরিপূর্ণতার জন্য, সহনশীল, পরমতসহিষ্ণু, ধর্মনিরেপক্ষ ও উদার মানসিকতার জন্য সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সহপাঠ কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে পরমতসহিষ্ণুতা, নানা শ্রেণি, নানা মতের শিক্ষার্থীদের ঐকমত্য। যে প্রতিযোগিতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা বেড়ে ওঠে, সেখানে সহমর্মিতা, অন্যের মতকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ থাকে না। ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে- এটাই অভিভাবকের চাওয়া। শিক্ষার্থীর চাওয়া-পাওয়াটা গৌণ। এত চাপের মধ্যে সৃজনশীলতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চার সময় কোথায়। এমন শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ হতে পারে সৃজনশীলতার বিকাশ ও মানবিক মূল্যবোধ চর্চার চমৎকার একটি মঞ্চ।
এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি একদিকে মেধাকে শানিত করে, অন্যদিকে অর্জিত জ্ঞানকে প্রয়োগ করার সুযোগ তেরি করে দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্য বইপত্রের মাঝে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে একজন শিক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি নেতৃত্ববোধ, মানবিকবোধ, সমাজ-রাষ্ট্র-নিজের বাস্তব জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার সম্ভবনা অনেক বেশি রয়েছে। এছাড়া আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি প্রয়োজন এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি, যা আপনাকে স্বপ্ন পূরণে পাথেয় হতে পারে। একজন শিক্ষার্থীর এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে তার নানা দক্ষতা সম্পর্কে জানা যায়। তাই একাডেমিক রেজাল্টের পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিও সমগুরুত্বপূর্ণ। কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, মানসিক বিকাশ, অভিজ্ঞতা লাভ, সামাজিকীকরণ, চাকরির প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা, দলগতভাবে কাজের শিক্ষা অর্জন, সামাজিক সুযোগগুলো উন্মুক্ত হওয়া, আত্মসম্মান বৃদ্ধি, নিজের আগ্রহ প্রকাশ করার সুযোগ অর্জন, একাডেমিক পারফরমেন্স উন্নত করা, সময়ের সদ্ব্যবহার, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি সুযোগ ও সুবিধা বা উপকারিতা অর্জিত হয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি থেকে।
পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে। তাদের ভেতরে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটায় এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। একজন শিক্ষার্থী যখন তার আগ্রহ ও পছন্দের কাজের সাথে যুক্ত থাকে, সেখান থেকে প্রচুর আনন্দ ও মানসিক শক্তি আসে, যা তাকে তার জীবনের অন্যান্য মানসিক চাপগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। তাছাড়া এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত থাকে, ফলে যখন একজন শিক্ষার্থী কোনো বিপদ বা মানসিক সংকটের মধ্য দিয়ে যায়, সহজেই অন্যদের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। মানসিকভাবে সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য এ ধরনের সামাজিক সহযোগিতা বা পারস্পরিক সহযোগিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব পাঠক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম যখন বিকাশমূলক না হয়ে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক হয় তখন তা খুব বেশি সহযোগিতা করে না বরং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেইসাথে টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব কার্যক্রমের অতিরিক্ত চাপ যদি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, বিশ্রাম বা পারিবারিক বন্ধন ও দায়িত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তা একজন শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ আমাদের মানসিক প্রশান্তি এ সবকিছুর ভারসাম্যের ওপরও নির্ভর করে।
যে সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধি করতে জানে, ধ্বংসের ভয়াবহতা তাকে আকৃষ্ট করে না। দলগত কাজের শক্তি যে বুঝতে শেখে, বিচ্ছিন্নতাবাদ তাকে বিভ্রান্ত করে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমের চর্চা তরুণদের দেয় সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্র, দলবদ্ধ হয়ে কাজ করার শিক্ষা। তাই হিংসা-বিদ্বেষ আর যুদ্ধ-বিগ্রহে যখন প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে পৃথিবী, তখন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা ভীষণ প্রয়োজন। সর্বোপরি বলা যায়, সফল ও সার্থক মানব জীবন গঠনে সহশিক্ষামূলক কার্যাবলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘হাওয়া খেলে যেমন পেট ভরে না, কিন্তু খাদ্য হজমের জন্য হাওয়ার প্রয়োজন’- ঠিক তেমনি শিক্ষাকে প্রকৃতভাবে অর্জন এবং জীবন উপযোগী করতে হলে সহশিক্ষাক্রমিক কার্যক্রম বড়ই দরকার। এ কারণে প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা ও জীবন মান গঠনে তাত্ত্বিক শিক্ষার পাশাপাশি সহশিক্ষাক্রমিক জ্ঞান প্রদান করা আবশ্যক- এ লক্ষ্যেই সবার কাজ করা উচিত।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক,
বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]