alt

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও প্রশ্নহীন প্রণোদনার বীজ

পাভেল পার্থ

: শনিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

দুর্যোগ, মন্দা কিংবা কোন সংকট কাটিয়ে ওঠা কিংবা ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানাভাবে কৃষি সহযোগিতা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি পালন করে। এর ভেতর বীজ প্রণোদনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রণোদনার বীজে দেশের কৃষি খাত আরো নিম্নগামী হচ্ছে। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনার বীজ চাষ করে কৃষকের সময়, শ্রম, জমি, অর্থ নষ্ট হচ্ছে। আর এসব বীজের মান পরীক্ষা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে না। এ ঘটনা দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যব্যবস্থায় এক চাপও তৈরি করছে। কারণ উৎপাদন কাক্সিক্ষত না হওয়ায়, খাদ্যের পূর্বাভাস ও ফলনের পরিমাণে গরমিল ঘটছে। দেশে বহুদিন ধরে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির বীজ ব্যবহার করে কৃষক প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কিন্তু কোনো ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় এর যাবতীয় ভোগান্তি একা কৃষক ও কৃষক পরিবারকে টানতে হয়। তবে করপোরেট কোম্পানি আর রাষ্ট্রের বীজ প্রণোদনা এক বিষয় নয়। যদি কোম্পানির মতো রাষ্ট্রের সরবরাহ করা বীজেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দেশের কৃষিসমাজ দাঁড়াবে কোথায়? এই ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে বোরো মৌসুম ও রবি শস্যের মৌসুমে। আমরা আশা করব দেশের বীজ খাতকে রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্বের জায়গায় বিবেচনায় নিবে। কারণ এটি আমাদের কৃষি ও খাদ্যের মৌলভিত্তি। বীজের অন্যথা হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নানামুখী প্রশ্নের মুখে পড়বে। বীজ সরবরাহ, বীজ বিক্রয় এবং বীজ প্রণোদনার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব ঘটনার তদন্ত ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যদুবয়রা ইউনিয়নের খড়িলা বিলের কৃষক তারিকুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বুনেছিলেন, কৃষি বিভাগ থেকে তাকে এক কেজি বীজ সহায়তা দেয়া হয়। বীজতলা থেকে জমিতে রোপণের পর সব পেঁয়াজ চারা মারা গেছে। পটুয়াখালীর বাউফলের মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামের কৃষক সেলিম হাওলাদার কৃষি অফিস থেকে এক কেজি সরিষা বীজ বপন করেছিলেন, কিন্তু অর্ধেকের বেশি বীজ থেকে চারা গজায়নি। রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় ৬৪ জেলার ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ কৃষককে বিনামূল্যে বীজ সুবিধা দেন। বীজ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া বোরো মৌসুমে হাইব্রিড (এসএল-৮ এইচ) ধানবীজ কৃষকদের বিনামূল্যে দেয়া হয় প্রায় ৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। আর সরকারের এই প্রণোদনার বীজই এখন বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার মটমুড়া ও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার জামজামি ইউনিয়নের কৃষকরা জানান প্রণোদনা পাওয়া বীজের ৮০ শতাংশই চারা গজায়নি। বগুড়ার সারিয়াকান্দির ১২টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ১২০০ কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সবজি বীজ বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু সেই বীজে চারা গজায়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। বিএডিসির ভুট্টা বীজে চারা না গজানোয় ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের ১২০০ কৃষকের প্রায় ৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬১০০ কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হাইব্রিড ধান বীজ থেকে চারা গজায়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। নীলফামারির ডিমলার খগাখড়িবাড়ি কামারপাড়া এলাকার বর্গাচাষি জয়ন্তী বালাও কৃষি বিভাগ থেকে সরিষা বীজ নিয়ে চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

শুধু এ বছর বা একটি মৌসুম নয়, শুধু একটি এলাকা নয়, প্রণোদনার বীজে দেশের নানা অঞ্চলের কৃষক অনেক বছর ধরেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বহু গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশিতও হয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ চাষ করে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর জানা যায় । রাজশাহীর তানোর ও দূর্গাপুরে প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ চাষ করে বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

কৃষির অন্যতম কেন্দ্রিয় খাত হলো বীজ। খনার বচন বাদে বাংলাদেশে সর্বপ্রাচীন বীজের বিজ্ঞাপন কেমন ছিল? দীর্ঘসময় বীজের বিজ্ঞাপন গ্রামীণ নারীর মাধ্যমেই প্রচারিত হতো। ‘অমুক গৃহস্থ বাড়ির লাউবীজ ভালো’, ‘তমুক পাড়ার ঝিঙ্গা ভালো’, ‘পাহাড়ি কুমড়া বেশি মিঠা’, ‘চরের মরিচ বেশি ঝাল’, ‘ময়মনসিংহের লাফা বেগুন নরম’, ‘সিলেটি লাই শাক’, ‘বালাম ধানে মুড়ি ভালো’, ‘মি.মিদ্দিমের চু ভালো’, ‘বিন্নি ধানের খৈ ভালো’, ‘লোহাটাং ভাত পেটে থাকে বেশি’, ‘খাসি-পানে ঝাল বেশি’, ‘দিনাজপুরের কাটারিভোগ’ কিংবা ‘ভাটির টেপী-রাতার পান্তা ভালো’ একসময় এমন পাবলিক বীজ-বিজ্ঞাপনগুলোই কৃষিসমাজে বেশি প্রচলিত ছিল। আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি-বিস্মৃতি হাতড়ে জানি এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা সম্ভব। ১৯৪১-১৯৪২ সনে প্রকাশিত ‘কৃষি-কথা’ সাময়িকীর তৃতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যার (এপ্রিল-মে) শেষ পৃষ্ঠায় বড় ফন্টে একটি বীজের বিজ্ঞাপন আছে।

বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে, ... ‘আলগা ভিতের ওপর যেমন শক্ত ইমারত গড়া যায় না, তেমন খারাপ বীজে ভালো ফসল জন্মায় না। বেশি ফসল যদি পেতে চান কৃষি-বিভাগের প্রবর্ত্তিত উন্নত বীজ বুনুন’। বীজ তো জীবন্ত এক প্রাণসত্তা, কৃষিচর্চার মাধ্যমে বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। এই বীজ তো কৃষকের ঘরে সুরক্ষিত থাকার কথা, বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেট আর ডিলারের দোকানে নয়। বীজের রূপ আর রূপের রূপান্তর তো কৃষিচর্চার ভেতর দিয়ে বিকশিত হওয়ার কথা। কোনো কোম্পানিার গবেষণাগারে জোর করে এর জেনেটিক অদলবদল তো হওয়ার কথা না। কিন্তু তাই তো ঘটে চলেছে। দেশি বীজবৈচিত্র্যকে হটিয়ে চালু হলো আধুনিক কৃষির নামে ‘উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজ, এরপর এলো হাইব্রিড এবং আবার অনুমোদন দেয়া হলো জেনেটিক ফসল ও বীজকে। তথাকথিত সবুজবিপ্লবের মাধ্যমে দেশের বীজ খাত থেকে জনমালিকানা বলা উচিত নারীর বীজ অধিকার কেড়ে নিয়ে করেপোরেট বীজ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আর এখন বীজহারানো কৃষক কেবল কোম্পানি নয়, রাষ্ট্রের প্রণোদনার বীজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ১৯৯০ সাল থেকে বীজনীতিতে নানামুখী সংশোধন আনে, যা, ক্রমান্বয়ে বেসরকারি খাতকে বেশি প্রলুব্ধ করে। কিন্তু তারপরও দেশের বীজ খাত দুর্বল এবং মানসম্মত বীজের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর। ১৯৭৭ সনে বাংলাদেশে প্রধম জাতীয় বীজ অধ্যাদেশ প্রণীত হয়। ১৯৮৯ সালে পয়লা জাতীয় বীজনীতির খসড়া তৈরি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে বিজ্ঞপ্তি আকারে জাতীয় বীজনীতি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে বীজ (সংশোধন) আইন (১৯৯৭), জাতীয় বীজ বিধিমালা (১৯৯৮), জাতীয় খাদ্য নীতি (২০০৬), বায়োসেফটি গাইডলাইন (২০০৮), উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন (২০১১), বায়োসেফটি রুলস (২০১২), জাতীয় জৈবকৃষি নীতি (২০১৭), বীজ আইন (২০১৮), জাতীয় বীজ নীতি (২০১৮) উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইন (২০১৯), উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিধিমালা (২০১৯) বীজ সম্পর্কিত এসব নীতি, বিধি ও আইন প্রণীত হয়।

করপোরেট কোম্পানি আর রাষ্ট্রের বীজ প্রণোদনা এক বিষয় নয়। যদি কোম্পানির মতো রাষ্ট্রের সরবরাহ করা বীজেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দেশের কৃষিসমাজ দাঁড়াবে কোথায়?

এসব বিধি মূলত বীজকে দেখেছে ‘পণ্য’ হিসেবে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও রাজনীতির ধারাবাহিক পরিবর্তনই এসব বিধিকে বারবার প্রভাবিত করেছে এবং পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আর তাই কোনো বীজ কোম্পানির প্যাকেট না সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজে থাকছে সেটি নিয়ে আমরা ভাবছি না। কিন্তু কৃষকের কাছে বীজের এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক মানে ও রূপকল্প আছে। বীজ বুনে যদি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সে আঘাত কৃষকের মাটি ও মন সর্বত্রই দারুণ ক্ষতের দাগ রেখে যায়। রাষ্ট্রকে কৃষকের এই ক্ষত সারাতে হবে, দাগের দিতে তাকাতে হবে।

২০১০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষকরা সিনজেনটার হাইব্রিড সবল টমেটো বীজ চাষ করে প্রতারিত হয় এবং দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তুলে। সিনজেনটার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সিনজেনটা বাজার থেকে সবল টমেটো বীজ তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এরপরও কৃষকের সঙ্গে কোম্পানির বীজ-প্রতারণা বন্ধ হয়নি। হাইব্রিড ঝলক ধান কিংবা মনস্যান্টোর হাইব্রিড ভুট্টা বীজ বুনেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বীজ প্রতারণারও বিচার হয়নি।

প্রতিদিন কৃষি জমি কমছে, বাড়ছে জলবায়ু সংকট। নানা আঘাত আর সংকট সামলে গ্রামীণ কৃষি পরিবারগুলো এখনো কৃষি নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘ করোনা মহামারীতে দেশ দুনিয়া সব লকডাউন হয়ে থাকলেও কৃষকসমাজ ছিল নির্ঘুম। আমাদের সামনে হাজির করেছে খাবার ভর্তি থালা। কৃষকের সম্মান ও মর্যাদা এখনো আমরা নিশ্চিত করিনি। কিন্তু বারবার বীজ নিয়ে কৃষকের সঙ্গে নানামুখী অনাচার প্রতারণা ও ক্ষতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যে বীজ আমাদের ভবিষ্যতের বেঁচে থাকবার শর্তপূরণ করে, সেই বীজ ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং শক্তিশালী পাবলিক কাঠামো গড়ে তুলবে এটি দীর্ঘদিনের দাবি। আশা করি রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার বীজ কৃষকের হাতে দেয়ার আগে এর যাবতীয় নিরীক্ষা ও যাচাই সম্পন্ন করা হবে। এই কর্মসূচিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে যাবতীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ নিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। আশা করি কৃষকের বীজের অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র সক্রিয় ও তৎপর হবে।

[লেখক: গবেষক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও প্রশ্নহীন প্রণোদনার বীজ

পাভেল পার্থ

শনিবার, ০৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

দুর্যোগ, মন্দা কিংবা কোন সংকট কাটিয়ে ওঠা কিংবা ফসলের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানাভাবে কৃষি সহযোগিতা ও সম্প্রসারণ কর্মসূচি পালন করে। এর ভেতর বীজ প্রণোদনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সরকারি প্রণোদনার বীজে দেশের কৃষি খাত আরো নিম্নগামী হচ্ছে। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনার বীজ চাষ করে কৃষকের সময়, শ্রম, জমি, অর্থ নষ্ট হচ্ছে। আর এসব বীজের মান পরীক্ষা বা জবাবদিহিতা নিশ্চিত হচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে না। এ ঘটনা দেশের সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যব্যবস্থায় এক চাপও তৈরি করছে। কারণ উৎপাদন কাক্সিক্ষত না হওয়ায়, খাদ্যের পূর্বাভাস ও ফলনের পরিমাণে গরমিল ঘটছে। দেশে বহুদিন ধরে বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানির বীজ ব্যবহার করে কৃষক প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কিন্তু কোনো ঘটনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় এর যাবতীয় ভোগান্তি একা কৃষক ও কৃষক পরিবারকে টানতে হয়। তবে করপোরেট কোম্পানি আর রাষ্ট্রের বীজ প্রণোদনা এক বিষয় নয়। যদি কোম্পানির মতো রাষ্ট্রের সরবরাহ করা বীজেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দেশের কৃষিসমাজ দাঁড়াবে কোথায়? এই ঘটনা বেশি দেখা যাচ্ছে বোরো মৌসুম ও রবি শস্যের মৌসুমে। আমরা আশা করব দেশের বীজ খাতকে রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্বের জায়গায় বিবেচনায় নিবে। কারণ এটি আমাদের কৃষি ও খাদ্যের মৌলভিত্তি। বীজের অন্যথা হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নানামুখী প্রশ্নের মুখে পড়বে। বীজ সরবরাহ, বীজ বিক্রয় এবং বীজ প্রণোদনার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব ঘটনার তদন্ত ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে।

কুষ্টিয়ার কুমারখালীর যদুবয়রা ইউনিয়নের খড়িলা বিলের কৃষক তারিকুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বুনেছিলেন, কৃষি বিভাগ থেকে তাকে এক কেজি বীজ সহায়তা দেয়া হয়। বীজতলা থেকে জমিতে রোপণের পর সব পেঁয়াজ চারা মারা গেছে। পটুয়াখালীর বাউফলের মদনপুরা ইউনিয়নের চন্দ্রপাড়া গ্রামের কৃষক সেলিম হাওলাদার কৃষি অফিস থেকে এক কেজি সরিষা বীজ বপন করেছিলেন, কিন্তু অর্ধেকের বেশি বীজ থেকে চারা গজায়নি। রবি মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে কৃষি মন্ত্রণালয় ৬৪ জেলার ১৬ লাখ ৭০ হাজার ৫০০ কৃষককে বিনামূল্যে বীজ সুবিধা দেন। বীজ বাবদ ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া বোরো মৌসুমে হাইব্রিড (এসএল-৮ এইচ) ধানবীজ কৃষকদের বিনামূল্যে দেয়া হয় প্রায় ৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। আর সরকারের এই প্রণোদনার বীজই এখন বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার মটমুড়া ও চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার জামজামি ইউনিয়নের কৃষকরা জানান প্রণোদনা পাওয়া বীজের ৮০ শতাংশই চারা গজায়নি। বগুড়ার সারিয়াকান্দির ১২টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ১২০০ কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে সবজি বীজ বিতরণ করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু সেই বীজে চারা গজায়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। বিএডিসির ভুট্টা বীজে চারা না গজানোয় ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের ১২০০ কৃষকের প্রায় ৬ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬১০০ কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হাইব্রিড ধান বীজ থেকে চারা গজায়নি বলে কৃষকদের অভিযোগ। নীলফামারির ডিমলার খগাখড়িবাড়ি কামারপাড়া এলাকার বর্গাচাষি জয়ন্তী বালাও কৃষি বিভাগ থেকে সরিষা বীজ নিয়ে চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

শুধু এ বছর বা একটি মৌসুম নয়, শুধু একটি এলাকা নয়, প্রণোদনার বীজে দেশের নানা অঞ্চলের কৃষক অনেক বছর ধরেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বহু গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রকাশিতও হয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ চাষ করে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর জানা যায় । রাজশাহীর তানোর ও দূর্গাপুরে প্রণোদনার পেঁয়াজ বীজ চাষ করে বহু কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

কৃষির অন্যতম কেন্দ্রিয় খাত হলো বীজ। খনার বচন বাদে বাংলাদেশে সর্বপ্রাচীন বীজের বিজ্ঞাপন কেমন ছিল? দীর্ঘসময় বীজের বিজ্ঞাপন গ্রামীণ নারীর মাধ্যমেই প্রচারিত হতো। ‘অমুক গৃহস্থ বাড়ির লাউবীজ ভালো’, ‘তমুক পাড়ার ঝিঙ্গা ভালো’, ‘পাহাড়ি কুমড়া বেশি মিঠা’, ‘চরের মরিচ বেশি ঝাল’, ‘ময়মনসিংহের লাফা বেগুন নরম’, ‘সিলেটি লাই শাক’, ‘বালাম ধানে মুড়ি ভালো’, ‘মি.মিদ্দিমের চু ভালো’, ‘বিন্নি ধানের খৈ ভালো’, ‘লোহাটাং ভাত পেটে থাকে বেশি’, ‘খাসি-পানে ঝাল বেশি’, ‘দিনাজপুরের কাটারিভোগ’ কিংবা ‘ভাটির টেপী-রাতার পান্তা ভালো’ একসময় এমন পাবলিক বীজ-বিজ্ঞাপনগুলোই কৃষিসমাজে বেশি প্রচলিত ছিল। আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি-বিস্মৃতি হাতড়ে জানি এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা সম্ভব। ১৯৪১-১৯৪২ সনে প্রকাশিত ‘কৃষি-কথা’ সাময়িকীর তৃতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যার (এপ্রিল-মে) শেষ পৃষ্ঠায় বড় ফন্টে একটি বীজের বিজ্ঞাপন আছে।

বিজ্ঞাপনটিতে বলা হয়েছে, ... ‘আলগা ভিতের ওপর যেমন শক্ত ইমারত গড়া যায় না, তেমন খারাপ বীজে ভালো ফসল জন্মায় না। বেশি ফসল যদি পেতে চান কৃষি-বিভাগের প্রবর্ত্তিত উন্নত বীজ বুনুন’। বীজ তো জীবন্ত এক প্রাণসত্তা, কৃষিচর্চার মাধ্যমে বংশপরম্পরায় টিকে থাকে। এই বীজ তো কৃষকের ঘরে সুরক্ষিত থাকার কথা, বহুজাতিক কোম্পানির প্যাকেট আর ডিলারের দোকানে নয়। বীজের রূপ আর রূপের রূপান্তর তো কৃষিচর্চার ভেতর দিয়ে বিকশিত হওয়ার কথা। কোনো কোম্পানিার গবেষণাগারে জোর করে এর জেনেটিক অদলবদল তো হওয়ার কথা না। কিন্তু তাই তো ঘটে চলেছে। দেশি বীজবৈচিত্র্যকে হটিয়ে চালু হলো আধুনিক কৃষির নামে ‘উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজ, এরপর এলো হাইব্রিড এবং আবার অনুমোদন দেয়া হলো জেনেটিক ফসল ও বীজকে। তথাকথিত সবুজবিপ্লবের মাধ্যমে দেশের বীজ খাত থেকে জনমালিকানা বলা উচিত নারীর বীজ অধিকার কেড়ে নিয়ে করেপোরেট বীজ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠিত হলো। আর এখন বীজহারানো কৃষক কেবল কোম্পানি নয়, রাষ্ট্রের প্রণোদনার বীজেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ১৯৯০ সাল থেকে বীজনীতিতে নানামুখী সংশোধন আনে, যা, ক্রমান্বয়ে বেসরকারি খাতকে বেশি প্রলুব্ধ করে। কিন্তু তারপরও দেশের বীজ খাত দুর্বল এবং মানসম্মত বীজের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর। ১৯৭৭ সনে বাংলাদেশে প্রধম জাতীয় বীজ অধ্যাদেশ প্রণীত হয়। ১৯৮৯ সালে পয়লা জাতীয় বীজনীতির খসড়া তৈরি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ২৫ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে বিজ্ঞপ্তি আকারে জাতীয় বীজনীতি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে বীজ (সংশোধন) আইন (১৯৯৭), জাতীয় বীজ বিধিমালা (১৯৯৮), জাতীয় খাদ্য নীতি (২০০৬), বায়োসেফটি গাইডলাইন (২০০৮), উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন (২০১১), বায়োসেফটি রুলস (২০১২), জাতীয় জৈবকৃষি নীতি (২০১৭), বীজ আইন (২০১৮), জাতীয় বীজ নীতি (২০১৮) উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ আইন (২০১৯), উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ বিধিমালা (২০১৯) বীজ সম্পর্কিত এসব নীতি, বিধি ও আইন প্রণীত হয়।

করপোরেট কোম্পানি আর রাষ্ট্রের বীজ প্রণোদনা এক বিষয় নয়। যদি কোম্পানির মতো রাষ্ট্রের সরবরাহ করা বীজেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দেশের কৃষিসমাজ দাঁড়াবে কোথায়?

এসব বিধি মূলত বীজকে দেখেছে ‘পণ্য’ হিসেবে এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ও রাজনীতির ধারাবাহিক পরিবর্তনই এসব বিধিকে বারবার প্রভাবিত করেছে এবং পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আর তাই কোনো বীজ কোম্পানির প্যাকেট না সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজে থাকছে সেটি নিয়ে আমরা ভাবছি না। কিন্তু কৃষকের কাছে বীজের এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক মানে ও রূপকল্প আছে। বীজ বুনে যদি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সে আঘাত কৃষকের মাটি ও মন সর্বত্রই দারুণ ক্ষতের দাগ রেখে যায়। রাষ্ট্রকে কৃষকের এই ক্ষত সারাতে হবে, দাগের দিতে তাকাতে হবে।

২০১০ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কৃষকরা সিনজেনটার হাইব্রিড সবল টমেটো বীজ চাষ করে প্রতারিত হয় এবং দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তুলে। সিনজেনটার বিরুদ্ধে মামলা হয়। সিনজেনটা বাজার থেকে সবল টমেটো বীজ তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এরপরও কৃষকের সঙ্গে কোম্পানির বীজ-প্রতারণা বন্ধ হয়নি। হাইব্রিড ঝলক ধান কিংবা মনস্যান্টোর হাইব্রিড ভুট্টা বীজ বুনেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বীজ প্রতারণারও বিচার হয়নি।

প্রতিদিন কৃষি জমি কমছে, বাড়ছে জলবায়ু সংকট। নানা আঘাত আর সংকট সামলে গ্রামীণ কৃষি পরিবারগুলো এখনো কৃষি নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। দীর্ঘ করোনা মহামারীতে দেশ দুনিয়া সব লকডাউন হয়ে থাকলেও কৃষকসমাজ ছিল নির্ঘুম। আমাদের সামনে হাজির করেছে খাবার ভর্তি থালা। কৃষকের সম্মান ও মর্যাদা এখনো আমরা নিশ্চিত করিনি। কিন্তু বারবার বীজ নিয়ে কৃষকের সঙ্গে নানামুখী অনাচার প্রতারণা ও ক্ষতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যে বীজ আমাদের ভবিষ্যতের বেঁচে থাকবার শর্তপূরণ করে, সেই বীজ ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্র সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখবে এবং শক্তিশালী পাবলিক কাঠামো গড়ে তুলবে এটি দীর্ঘদিনের দাবি। আশা করি রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার বীজ কৃষকের হাতে দেয়ার আগে এর যাবতীয় নিরীক্ষা ও যাচাই সম্পন্ন করা হবে। এই কর্মসূচিকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে যাবতীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ নিয়ে দাঁড়াবে রাষ্ট্র। আশা করি কৃষকের বীজের অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্র সক্রিয় ও তৎপর হবে।

[লেখক: গবেষক]

back to top