বি কে বোস
করোনা (COVID-19) আজকের বিশ্বের আতঙ্কের আরেক নাম হলো এ সংক্রমণ ব্যাধি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম এই রোগের আবির্ভাবের পর হতে আজও পৃথিবীতে এ রোগের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। আমরা প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউ অতিক্রম করছি। সবসময়ই দ্বিতীয় ঢেউয়ে অতিমারীর সময়ে আক্রান্ত বেশি হয় এবং মৃতের সংখ্যাও বেশি হয়। যেমনটি আমরা ১৯১৮-১৯২১ সালের স্প্যানিস ফ্লুতে দেখেছি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মতো দিনাজপুরেও জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। গত সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার হিসাব মোতাবেক দিনাজপুরে ৪৮% শনাক্তের হার ছিল; যাকে সংক্রমণ ব্যাধির নিয়মে প্রোগ্রেসিভ স্টেজ বলা হয়। এ মুহূর্তে দিনাজপুরে সংক্রমণ কমানোর জন্য সদর উপজেলায় লকডাউন চলছে।
উপসর্গ বিবেচনায় করোনার সংক্রমণকে মৃদু, মাঝারি এবং অতিমাত্রার উপসর্গ হিসেবে ভাগ করা হয়। এছাড়া কিছু মানুষ উপসর্গহীনভাবে সংক্রমিত হতে পারে এবং অন্যকেও আক্রান্ত করতে পারে। উপসর্গ বিবেচনায় শতকরা ৮০ ভাগ রোগ-ই মৃদু উপসর্গ হিসেবে থাকে। শতকরা ১৫ ভাগ মাঝারি উপসর্গ এবং শতকরা ৫ ভাগ অতিমাত্রার উপসর্গ নিয়ে প্রকাশ করতে পারে। মাঝারি ও অতিমাত্রার উপসর্গের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়, কিন্তু মৃদু উপসর্গের রোগীরা বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে পারেন।
জেনে নেই মৃদু উপসর্গগুলো কী কী
জ্বর, ক্ষুধা মন্দা, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, সর্দি, বমি, স্বাদ ও ঘ্রাণ না পাওয়া, চোখ লাল হওয়া, শরীর ব্যথা, পেট ব্যথা, ক্লান্তি অনুভব হওয়া, চর্মে লালচে দাগ হওয়া।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা লক্ষ্য করছি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে আগের উপসর্গগুলো অনেকটাই ম্লান হয়েছে। প্রথমদিকে যেসব উপসর্গ বা সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তার অনেকগুলোই বদলে গেছে। গত দেড় বছরে বহুবার প্রজাতি পরিবর্তন করেছে করোনাভাইরাস। প্রথমদিকে খাবারের স্বাদ আর গন্ধ একেবারেই হারিয়ে যাওয়া, গলা ব্যথা, কাশি- এগুলো ছিল করোনার মূল উপসর্গ। নতুন ভ্যারিয়েন্টে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন; যা আগে দেখা যায়নি। এমনকি নতুন ভ্যারিয়েন্টে শিশু-কিশোররাও আক্রান্ত হচ্ছে। কেবল বৃদ্ধ বা অসুস্থরা নন, যুবক ও মধ্যবয়সীদেরও হঠাৎ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে বা অক্সিজেন দরকার হচ্ছে। নতুন এ ধরন আগের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক বলে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কী চিকিৎসা নেবেন মৃদু উপসর্গে
১. মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগী কিন্তু অন্যকোন রোগ নেই সেক্ষেত্রে-
বাসায় একটি কক্ষে থাকতে হবে (Home Isolation)। বাড়িতে এ সুবিধা না থাকলে হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টারে যেতে হবে। বাড়ির অন্যদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। রোগী এবং যিনি রোগীর সেবা করবেন, দুইজনকেই মাস্ক পরিধান করতে হবে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রাম ১ থেকে ২টা বড়ি ৩-৪ বার প্রতিদিন খাবেন। সর্দি থাকলে এন্টিহিস্টামিন বড়ি খাবেন। কাশি থাকলে কফ সিরাপ খেতে পারেন। শ্বাসকষ্ট হলে বুডিসোনাইড স্টেরয়েড ইনহেলার ২০০ মাইক্রোগ্রাম দিনে দুইবার করে টানবেন। একটি পালস-অক্সিমিটার দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করতে হবে।
২. মৃদু উপসর্গ যুক্ত রোগী কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, হার্ট, লিভার, অ্যাজমা বা সিওপিডি (ঈঙচউ) রোগ থাকলে-
উপরে উল্লেখিত চিকিৎসার সঙ্গে রক্ত জমাট যেন না বাঁধে সেজন্য ওষুধ খেতে হবে।
মৃদু উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে কখন ভর্তি হবেন (ডেঞ্জার সাইন)
যদি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়। বুকে ব্যথা হয়। অত্যন্ত দুর্বল অনুভব করেন। মাথা হালকা অনুভব করা (Light headedness)। হঠাৎ জ্ঞান হারানো। অথবা অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩% এর নিচে নেমে গেলে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
সর্বোপরি মৃদু উপসর্গ যুক্ত করোনা আক্রান্ত রোগী যাদের কোন পূর্ব রোগ নেই তারা হোম আইসোলেশন এবং উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণ করে দ্রুত রোগ মুক্তি পেতে পারেন। অপরপক্ষে মৃদু উপসর্গ কিন্তু অন্যকোন রোগ পূর্ব থেকেই আছে তাদের হোম আইসোলেশন, উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাসহ রক্ত জমাট না বাঁধার ওষুধ নিতে হবে এবং কোন ধরনের বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩% এর নিচে নেমে গেলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সর্বোপরি হোম আইসোলেশনে সব সংক্রমিত রোগীকেই ১৪ দিন থাকতে হবে। এভাবেই করোনার মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগীরা বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিতে পারেন।
[লেখক : বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও পরিচালক, পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র, দিনাজপুর]
বি কে বোস
বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই ২০২১
করোনা (COVID-19) আজকের বিশ্বের আতঙ্কের আরেক নাম হলো এ সংক্রমণ ব্যাধি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে চীনের উহান প্রদেশে প্রথম এই রোগের আবির্ভাবের পর হতে আজও পৃথিবীতে এ রোগের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। আমরা প্রথম ঢেউয়ের পর দ্বিতীয় ঢেউ অতিক্রম করছি। সবসময়ই দ্বিতীয় ঢেউয়ে অতিমারীর সময়ে আক্রান্ত বেশি হয় এবং মৃতের সংখ্যাও বেশি হয়। যেমনটি আমরা ১৯১৮-১৯২১ সালের স্প্যানিস ফ্লুতে দেখেছি। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মতো দিনাজপুরেও জুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। গত সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার হিসাব মোতাবেক দিনাজপুরে ৪৮% শনাক্তের হার ছিল; যাকে সংক্রমণ ব্যাধির নিয়মে প্রোগ্রেসিভ স্টেজ বলা হয়। এ মুহূর্তে দিনাজপুরে সংক্রমণ কমানোর জন্য সদর উপজেলায় লকডাউন চলছে।
উপসর্গ বিবেচনায় করোনার সংক্রমণকে মৃদু, মাঝারি এবং অতিমাত্রার উপসর্গ হিসেবে ভাগ করা হয়। এছাড়া কিছু মানুষ উপসর্গহীনভাবে সংক্রমিত হতে পারে এবং অন্যকেও আক্রান্ত করতে পারে। উপসর্গ বিবেচনায় শতকরা ৮০ ভাগ রোগ-ই মৃদু উপসর্গ হিসেবে থাকে। শতকরা ১৫ ভাগ মাঝারি উপসর্গ এবং শতকরা ৫ ভাগ অতিমাত্রার উপসর্গ নিয়ে প্রকাশ করতে পারে। মাঝারি ও অতিমাত্রার উপসর্গের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়, কিন্তু মৃদু উপসর্গের রোগীরা বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে পারেন।
জেনে নেই মৃদু উপসর্গগুলো কী কী
জ্বর, ক্ষুধা মন্দা, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, সর্দি, বমি, স্বাদ ও ঘ্রাণ না পাওয়া, চোখ লাল হওয়া, শরীর ব্যথা, পেট ব্যথা, ক্লান্তি অনুভব হওয়া, চর্মে লালচে দাগ হওয়া।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমরা লক্ষ্য করছি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে আগের উপসর্গগুলো অনেকটাই ম্লান হয়েছে। প্রথমদিকে যেসব উপসর্গ বা সমস্যা বেশি দেখা দিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তার অনেকগুলোই বদলে গেছে। গত দেড় বছরে বহুবার প্রজাতি পরিবর্তন করেছে করোনাভাইরাস। প্রথমদিকে খাবারের স্বাদ আর গন্ধ একেবারেই হারিয়ে যাওয়া, গলা ব্যথা, কাশি- এগুলো ছিল করোনার মূল উপসর্গ। নতুন ভ্যারিয়েন্টে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হচ্ছেন; যা আগে দেখা যায়নি। এমনকি নতুন ভ্যারিয়েন্টে শিশু-কিশোররাও আক্রান্ত হচ্ছে। কেবল বৃদ্ধ বা অসুস্থরা নন, যুবক ও মধ্যবয়সীদেরও হঠাৎ অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে বা অক্সিজেন দরকার হচ্ছে। নতুন এ ধরন আগের তুলনায় অনেক বেশি সংক্রামক বলে অনেক দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কী চিকিৎসা নেবেন মৃদু উপসর্গে
১. মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগী কিন্তু অন্যকোন রোগ নেই সেক্ষেত্রে-
বাসায় একটি কক্ষে থাকতে হবে (Home Isolation)। বাড়িতে এ সুবিধা না থাকলে হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টারে যেতে হবে। বাড়ির অন্যদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। রোগী এবং যিনি রোগীর সেবা করবেন, দুইজনকেই মাস্ক পরিধান করতে হবে। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ৫০০ মিলিগ্রাম ১ থেকে ২টা বড়ি ৩-৪ বার প্রতিদিন খাবেন। সর্দি থাকলে এন্টিহিস্টামিন বড়ি খাবেন। কাশি থাকলে কফ সিরাপ খেতে পারেন। শ্বাসকষ্ট হলে বুডিসোনাইড স্টেরয়েড ইনহেলার ২০০ মাইক্রোগ্রাম দিনে দুইবার করে টানবেন। একটি পালস-অক্সিমিটার দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করতে হবে।
২. মৃদু উপসর্গ যুক্ত রোগী কিন্তু ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, হার্ট, লিভার, অ্যাজমা বা সিওপিডি (ঈঙচউ) রোগ থাকলে-
উপরে উল্লেখিত চিকিৎসার সঙ্গে রক্ত জমাট যেন না বাঁধে সেজন্য ওষুধ খেতে হবে।
মৃদু উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে কখন ভর্তি হবেন (ডেঞ্জার সাইন)
যদি হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়। বুকে ব্যথা হয়। অত্যন্ত দুর্বল অনুভব করেন। মাথা হালকা অনুভব করা (Light headedness)। হঠাৎ জ্ঞান হারানো। অথবা অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩% এর নিচে নেমে গেলে দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
সর্বোপরি মৃদু উপসর্গ যুক্ত করোনা আক্রান্ত রোগী যাদের কোন পূর্ব রোগ নেই তারা হোম আইসোলেশন এবং উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা গ্রহণ করে দ্রুত রোগ মুক্তি পেতে পারেন। অপরপক্ষে মৃদু উপসর্গ কিন্তু অন্যকোন রোগ পূর্ব থেকেই আছে তাদের হোম আইসোলেশন, উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাসহ রক্ত জমাট না বাঁধার ওষুধ নিতে হবে এবং কোন ধরনের বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট বা অক্সিজেনের মাত্রা ৯৩% এর নিচে নেমে গেলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সর্বোপরি হোম আইসোলেশনে সব সংক্রমিত রোগীকেই ১৪ দিন থাকতে হবে। এভাবেই করোনার মৃদু উপসর্গযুক্ত রোগীরা বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিতে পারেন।
[লেখক : বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ও পরিচালক, পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র, দিনাজপুর]