alt

উপ-সম্পাদকীয়

বারবার কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে

সজীব ওয়াফি

: রোববার, ২৮ নভেম্বর ২০২১
image

মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। কাজ করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে, ঢাকায়। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে নিজস্ব গাড়িতে বের হয়েছেন। স্কুল কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা তার গাড়ি আটকে দিয়েছে যাত্রাবাড়ীতে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে রওনা করেছেন তিনি। চোখেমুখে কোন ক্ষোভ নেই। আন্দোলনে সামিল হয়েছে তার মেয়েও। সড়কের অনিয়ম শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। কিছুদূর হেঁটে যাত্রা করতে হলেও ভদ্রলোকের ভেতরে খুশিই অনুভূত হয়েছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন আমরা বড়রা যেটা পারিনি ছোট ছোট ছাত্ররা সেটা শিখাচ্ছে, এটা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য আশার বাণী। বলছিলাম ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। এর ভেতরেই ঘটেছে আরেকজন ছাত্রের মৃত্যু। নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাইম হাসান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেছে। ধরাধরি হওয়ার পরে গণমাধ্যম উঠে এলো গাড়ির চালক কোন ড্রাইভার ছিলেন না; তিনি আসলে সিটি করপোরেশনের একজন ক্লিনার এবং এ রকমের আরও ২০০ ক্লিনার আছেন যারা গাড়ি চালাচ্ছেন। ছাত্ররা তার সহপাঠী মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকার ব্যস্ততম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখলে নিয়ে বিক্ষোভ করছে। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই, মাত্র একদিনের ব্যবধানে সিটি করপোরেশনের ময়লার অন্য একটি গাড়ি প্রাণ হরণ করেছে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একজন কর্মীর।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই, রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হন। ক্লাস শেষে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি বাসে উঠতেছেন এইরকম সময়ে যাত্রী পাওয়ার প্রতিযোগিতায় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস বামপাশ থেকে ফুটপাতে ঢুকে। অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের গায়ের ওপর যায় মুহূর্তের ভেতর। দুজন শিক্ষার্থী বাসের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে। সড়কে গাড়ির এমন বেপরোয়া চলাচল এবং সহপাঠীর মৃত্যুতে ছাত্ররা বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। আন্দোলন শুরু হয় সারা শহরজুড়ে। এরপর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্কুল-কলেজের কিশোর-কিশোরীরাই দায়িত্ব নেয়।

সাধারণ মানুষও সেই এক সপ্তাহের চলাচলে নিরাপদ বোধ করে। নিরাপদ চলাচলে ভবিষ্যতের আশা জাগে জনগণের ভেতর যে একবার বুঝি একটা পরিবর্তন এলো। না, সে পরিবর্তন আর হয়নি। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার পরে যেই নৈরাজ্য সেই থেকে গেল। সারা বছরজুড়ে সড়কে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিল একমাত্র বাসের বেপরোয়া গতি এবং শৃঙ্খলার অভাবে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আন্দোলন পরবর্তী সারাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২২৭ জন এবং ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯৬৯ জন এবং নিহত হওয়া এই সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর ভেতরে বেশিরভাগ হয়েছে রাজধানী ঢাকায়।

আন্দোলনকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাতে লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলো-‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। সাময়িক অসুবিধা হলেও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অত্যন্ত প্রসন্ন হয়, শিক্ষার্থীরাও কুড়িয়েছিল বিপুল সমর্থন। শিক্ষার্থীদের সপ্তাহখানেকের আন্দোলনে বেরিয়ে পড়ে সড়ক অব্যবস্থাপনার বেহাল দশা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির এবং ড্রাইভারের বৈধ কাগজপত্র না থাকা, পুলিশি ড্রেস পরা বাইকারের লাইসেন্স না থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এমনকি নিজেরা বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত গাড়িতে অসুবিধা থাকলেও তারা আটকে দেয়া ইত্যাদি সারাদেশের মানুষের সামনে চেহারা খুলে দিয়েছিল। সড়কে নিয়মতান্ত্রিক গাড়ি চালানো যে অসম্ভব কিছু না সেটা তারা দেখিয়েছে। বাবা-মায়েরা আন্দোলনকারী সন্তানদের রাস্তায় ভাত খাওয়াই দিয়েছেন। শুধু তাদের সন্তানদেরই দেননি, খাওয়াই দিয়েছেন তাদের বন্ধুদেরও। জরুরি কাজে ব্যবহৃত বাহন এবং অ্যাম্বুলেন্সকে শিক্ষার্থীরা আটকে রাখেনি।

কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করায় জনজীবনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম বাড়ায় বাসের ভাড়া বাড়াতে চলে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘট। পরিশেষে বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। অথচ কোন পরিবারের আয় বাড়েনি। বরঞ্চ দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে হাঁসফাঁস পরিস্থিতি। ডলারের মান টাকায় পড়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। তৈরি হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। আমাদের দেশে করোনা মহামারির আগে থেকেই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছেন। করোনায় সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। অনেক মানুষ ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে বরণ করেছেন বেকারত্ব। শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। যারা বাধ্য হয়ে শহরেই কোনমতে থেকে গিয়েছেন তারা পড়েছেন বিপদে। এরকম সময়ে সবদিকের খরচ বেড়ে যাওয়া, ছাত্রদের বাস ভাড়া বেড়ে যাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর উপরে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে ছাত্রদের পড়াশোনায় একটু সুবিধা দেয়া কখনোই খরচ নয়, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। যে বিনিয়োগের ফলাফল শুধু ভবিষ্যতে জন্য পুঞ্জীভূত সম্পদ।

১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। পতন হয় স্বৈরাচার আইয়ুব খানের। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ক্ষমতার কলকাঠি। ছাত্রদের সেই ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবির প্রথম এবং অন্যতম দাবি হচ্ছে যাতায়াতে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার (কন্সেসন) দাবি। সেখানেও গণপরিবহনে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার দাবি ছাত্রদের পেছনে বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০২১ সালে এসে ঊনসত্তর সালের দাবির বিরুদ্ধে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের একটি স্তম্ভকে খারিজ করে দেয়ার সামিল।

দুর্ঘটনা ঘটলেই সেখানে নিহতের নামে একটা ফুটওভার ব্রিজ করে দেয়ার প্রস্তাব আসে। বারবারই বিচারের আশ্বাস দিচ্ছে শুধু। অথচ মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে বাস চলাচলের প্রতিযোগিতা থামানো হচ্ছে না কেন! ড্রাইভারের পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ক্লিনার দিয়ে কেন গাড়ি চালান সেই প্রশ্ন উঠছে না! যেখানে সিটি করপোরেশন রাতে ময়লা পরিষ্কারের কথা, সেখানে দিনে বেলায় কেন তাদের গাড়ি চলবে? একজন মারা গেলে সেখানে ফুটওভার ব্রিজ করার আশ্বাস কি সমাধান! নাকি মৃত্যুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার প্রহসন করা? জীবনের মূল্য কি টাকার অঙ্কে ক্ষতিপূরণ সম্ভব? কখনোই সম্ভব নয়; কাজেই শিক্ষার্থীদের দেখানো পথে নিয়মতান্ত্রিক ট্রাফিক পরিচালনা করলে দুর্ঘটনার হার যেমন শূন্যে নামবে, তেমনি যানজটেরও মুক্তি মিলবে। আমরা আর কোন মৃত্যু নিতে পারছি না। বেশি ট্রিপ মারার প্রতিযোগিতায় না নামিয়ে, সব গণপরিবহন শ্রমিকদের বেতন কাঠামো নির্দিষ্টকরণ এবং আইন বাস্তবায়নের দাবি এখন জীবন রক্ষার দাবি।

২০১৮ সালে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ আশা জাগলেও সেটা স্থায়ী হয়নি। অচিরেই আশা ধূলিসাৎ হয়েছে। ফলে পুনরায় সড়কে কাঠামোগত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। নাইম হাসানের মৃত্যুতে আবার শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ময়দানে উজ্জীবিত হয়েছে। নতুন করে পথ দেখাচ্ছে। সবাই সড়কে পরিবর্তনের আশা দেখছেন শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। ১৮ বছর বয়সী ছুঁই ছুঁই এ সব কিশোর-কিশোরীদের ওপর ভরসা করেই ক্ষণজন্মা কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন-

‘এ বয়স জেন ভীরু, কাপুরষ নয়/পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,/এ বয়সে তাই নেই কোন সংশয়-/এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বারবার কেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে

সজীব ওয়াফি

image

রোববার, ২৮ নভেম্বর ২০২১

মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম। কাজ করেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে, ঢাকায়। অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে নিজস্ব গাড়িতে বের হয়েছেন। স্কুল কলেজে পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা তার গাড়ি আটকে দিয়েছে যাত্রাবাড়ীতে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যে রওনা করেছেন তিনি। চোখেমুখে কোন ক্ষোভ নেই। আন্দোলনে সামিল হয়েছে তার মেয়েও। সড়কের অনিয়ম শিক্ষার্থীরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। কিছুদূর হেঁটে যাত্রা করতে হলেও ভদ্রলোকের ভেতরে খুশিই অনুভূত হয়েছিল। কথায় কথায় তিনি বললেন আমরা বড়রা যেটা পারিনি ছোট ছোট ছাত্ররা সেটা শিখাচ্ছে, এটা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য আশার বাণী। বলছিলাম ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কথা।

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীরা গণপরিবহনে হাফ ভাড়ার দাবিতে আন্দোলন করছে। এর ভেতরেই ঘটেছে আরেকজন ছাত্রের মৃত্যু। নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাইম হাসান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যুবরণ করেছে। ধরাধরি হওয়ার পরে গণমাধ্যম উঠে এলো গাড়ির চালক কোন ড্রাইভার ছিলেন না; তিনি আসলে সিটি করপোরেশনের একজন ক্লিনার এবং এ রকমের আরও ২০০ ক্লিনার আছেন যারা গাড়ি চালাচ্ছেন। ছাত্ররা তার সহপাঠী মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হয়েছে। ঢাকার ব্যস্ততম গুরুত্বপূর্ণ সড়ক দখলে নিয়ে বিক্ষোভ করছে। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই, মাত্র একদিনের ব্যবধানে সিটি করপোরেশনের ময়লার অন্য একটি গাড়ি প্রাণ হরণ করেছে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একজন কর্মীর।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই, রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হন। ক্লাস শেষে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি বাসে উঠতেছেন এইরকম সময়ে যাত্রী পাওয়ার প্রতিযোগিতায় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস বামপাশ থেকে ফুটপাতে ঢুকে। অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের গায়ের ওপর যায় মুহূর্তের ভেতর। দুজন শিক্ষার্থী বাসের নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে। সড়কে গাড়ির এমন বেপরোয়া চলাচল এবং সহপাঠীর মৃত্যুতে ছাত্ররা বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। আন্দোলন শুরু হয় সারা শহরজুড়ে। এরপর সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্কুল-কলেজের কিশোর-কিশোরীরাই দায়িত্ব নেয়।

সাধারণ মানুষও সেই এক সপ্তাহের চলাচলে নিরাপদ বোধ করে। নিরাপদ চলাচলে ভবিষ্যতের আশা জাগে জনগণের ভেতর যে একবার বুঝি একটা পরিবর্তন এলো। না, সে পরিবর্তন আর হয়নি। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার পরে যেই নৈরাজ্য সেই থেকে গেল। সারা বছরজুড়ে সড়কে অসংখ্য মানুষ প্রাণ দিল একমাত্র বাসের বেপরোয়া গতি এবং শৃঙ্খলার অভাবে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) সংগঠনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আন্দোলন পরবর্তী সারাদেশে ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ২২৭ জন এবং ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯৬৯ জন এবং নিহত হওয়া এই সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর ভেতরে বেশিরভাগ হয়েছে রাজধানী ঢাকায়।

আন্দোলনকালীন সময়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে হাতে লেখা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছিলো-‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’। সাময়িক অসুবিধা হলেও সব শ্রেণী-পেশার মানুষ অত্যন্ত প্রসন্ন হয়, শিক্ষার্থীরাও কুড়িয়েছিল বিপুল সমর্থন। শিক্ষার্থীদের সপ্তাহখানেকের আন্দোলনে বেরিয়ে পড়ে সড়ক অব্যবস্থাপনার বেহাল দশা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ির এবং ড্রাইভারের বৈধ কাগজপত্র না থাকা, পুলিশি ড্রেস পরা বাইকারের লাইসেন্স না থাকা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এমনকি নিজেরা বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত গাড়িতে অসুবিধা থাকলেও তারা আটকে দেয়া ইত্যাদি সারাদেশের মানুষের সামনে চেহারা খুলে দিয়েছিল। সড়কে নিয়মতান্ত্রিক গাড়ি চালানো যে অসম্ভব কিছু না সেটা তারা দেখিয়েছে। বাবা-মায়েরা আন্দোলনকারী সন্তানদের রাস্তায় ভাত খাওয়াই দিয়েছেন। শুধু তাদের সন্তানদেরই দেননি, খাওয়াই দিয়েছেন তাদের বন্ধুদেরও। জরুরি কাজে ব্যবহৃত বাহন এবং অ্যাম্বুলেন্সকে শিক্ষার্থীরা আটকে রাখেনি।

কিছুদিন আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করায় জনজীবনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তেলের দাম বাড়ায় বাসের ভাড়া বাড়াতে চলে পরিবহন মালিকদের ধর্মঘট। পরিশেষে বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়। অথচ কোন পরিবারের আয় বাড়েনি। বরঞ্চ দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে হাঁসফাঁস পরিস্থিতি। ডলারের মান টাকায় পড়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। তৈরি হয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। আমাদের দেশে করোনা মহামারির আগে থেকেই জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছেন। করোনায় সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। অনেক মানুষ ছাঁটাইয়ের কবলে পড়ে বরণ করেছেন বেকারত্ব। শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। যারা বাধ্য হয়ে শহরেই কোনমতে থেকে গিয়েছেন তারা পড়েছেন বিপদে। এরকম সময়ে সবদিকের খরচ বেড়ে যাওয়া, ছাত্রদের বাস ভাড়া বেড়ে যাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর উপরে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। অন্যদিকে ছাত্রদের পড়াশোনায় একটু সুবিধা দেয়া কখনোই খরচ নয়, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ। যে বিনিয়োগের ফলাফল শুধু ভবিষ্যতে জন্য পুঞ্জীভূত সম্পদ।

১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির আন্দোলনে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। পতন হয় স্বৈরাচার আইয়ুব খানের। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ক্ষমতার কলকাঠি। ছাত্রদের সেই ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবির প্রথম এবং অন্যতম দাবি হচ্ছে যাতায়াতে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার (কন্সেসন) দাবি। সেখানেও গণপরিবহনে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার দাবি ছাত্রদের পেছনে বিনিয়োগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০২১ সালে এসে ঊনসত্তর সালের দাবির বিরুদ্ধে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের একটি স্তম্ভকে খারিজ করে দেয়ার সামিল।

দুর্ঘটনা ঘটলেই সেখানে নিহতের নামে একটা ফুটওভার ব্রিজ করে দেয়ার প্রস্তাব আসে। বারবারই বিচারের আশ্বাস দিচ্ছে শুধু। অথচ মৃত্যুর মিছিল রোধ করতে বাস চলাচলের প্রতিযোগিতা থামানো হচ্ছে না কেন! ড্রাইভারের পরিবর্তে সিটি করপোরেশন ক্লিনার দিয়ে কেন গাড়ি চালান সেই প্রশ্ন উঠছে না! যেখানে সিটি করপোরেশন রাতে ময়লা পরিষ্কারের কথা, সেখানে দিনে বেলায় কেন তাদের গাড়ি চলবে? একজন মারা গেলে সেখানে ফুটওভার ব্রিজ করার আশ্বাস কি সমাধান! নাকি মৃত্যুর সঙ্গে দ্বিতীয়বার প্রহসন করা? জীবনের মূল্য কি টাকার অঙ্কে ক্ষতিপূরণ সম্ভব? কখনোই সম্ভব নয়; কাজেই শিক্ষার্থীদের দেখানো পথে নিয়মতান্ত্রিক ট্রাফিক পরিচালনা করলে দুর্ঘটনার হার যেমন শূন্যে নামবে, তেমনি যানজটেরও মুক্তি মিলবে। আমরা আর কোন মৃত্যু নিতে পারছি না। বেশি ট্রিপ মারার প্রতিযোগিতায় না নামিয়ে, সব গণপরিবহন শ্রমিকদের বেতন কাঠামো নির্দিষ্টকরণ এবং আইন বাস্তবায়নের দাবি এখন জীবন রক্ষার দাবি।

২০১৮ সালে ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’ আশা জাগলেও সেটা স্থায়ী হয়নি। অচিরেই আশা ধূলিসাৎ হয়েছে। ফলে পুনরায় সড়কে কাঠামোগত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। নাইম হাসানের মৃত্যুতে আবার শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ময়দানে উজ্জীবিত হয়েছে। নতুন করে পথ দেখাচ্ছে। সবাই সড়কে পরিবর্তনের আশা দেখছেন শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। ১৮ বছর বয়সী ছুঁই ছুঁই এ সব কিশোর-কিশোরীদের ওপর ভরসা করেই ক্ষণজন্মা কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন-

‘এ বয়স জেন ভীরু, কাপুরষ নয়/পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,/এ বয়সে তাই নেই কোন সংশয়-/এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’

back to top