alt

উপ-সম্পাদকীয়

জগৎজ্যোতি দাস : ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

মোস্তাফা জব্বার

: সোমবার, ২৯ নভেম্বর ২০২১

তিন

বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে লেখাটির পরের অংশ শুরু হয়েছে এভাবে, “নিষ্ঠুরের মতো ইলিয়াসের ঘোর ভাঙেন হাসান মুর্শেদ। প্রশ্ন করেন, “তারপর কি হলো ইলিয়াস ভাই?” ইলিয়াস বলেন সেই অসম্ভব যন্ত্রণার গল্প। প্রিয় কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদা পানির ভেতর যতটা সম্ভব পুঁতে ফেলতে হয় তাকে, যেন শত্রুর হাতে এই বীরের কোন অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজিটার সঙ্গে তুলে নেন দলনেতার এলএমজিটাও। বুকে বাঁধা গামছা থেকে চুইয়ে পড়তে থাকা রক্ত উপেক্ষা করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পেছনে ফিরতে থাকেন ইলিয়াস।

ইলিয়াসের চেষ্টাটুকু সফল হয় না। পরদিন সকালে লাশ কাদা-পানি ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে। রাজাকার তেলাপোকাগুলো বেরিয়ে আসে তখন, টেনে-হিঁচড়ে লাশটা নিয়ে আসে তাদের ঘাঁটটিতে। তারপর জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না, জ্যোতির বাম হাতে একটা আঙ্গুল বেশি।

কেন জ্যোতির মা সন্তানের লাশকে অগ্রাহ্য করেছিলেন? মা হয়ে কীভাবে এ সাহস করলেন তিনি? তিনি কি তখন তার স্বামী আর বেঁচে থাকা অপর সন্তানের জীবন বাঁচানোর কথা ভাবছিলেন? জানা যাবে না আর কখনোই। মারা গেছেন তিনি ক’বছর আগে।

তাতে খুব বেশি লাভ হলো না। বাড়ি ফিরে যেতে যেতে জ্যোতির বাবা-মা দেখলেন, তাদের ভিটায় আগুন, জ্বলছে সব। ওদিকে নর্দমার ময়লায় লুকিয়ে থাকা রাজাকার তেলাপোকাগুলো জ্যোতির লাশটা নৌকার সামনে বেঁধে নিল, আজমিরীগঞ্জ থেকে জলসুখা পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে উৎকট উৎসাহের সঙ্গে প্রদর্শন করল ‘গাদ্দার’-এর লাশ, পৈশাচিক উল্লাসে।

তারপর আজমিরীগঞ্জ পৌঁছে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত লাশটা বেঁধে রাখল তারা, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে জানালো, এই হচ্ছে সেই কুখ্যাত ভারতীয় দালাল, গাদ্দার...”

হাসান মুর্শেদের দেয়া তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, “১৬ নভেম্বর জগৎজ্যোতির মৃত্যুদিন। প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল জগৎজ্যোতি দাসের, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জগৎজ্যোতির মৃত্যুর পর তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বভূষণ দেবার কথা বলা হয়েছিল বারবার, কিন্তু অব্যাখ্যানীয় কোন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি, বীরশ্রেষ্ঠ তো দূরে থাক, ভাটি অঞ্চলের কিংবদন্তি জগৎজ্যোতিকে আজ প্রায় কেউই চেনে না।”

জগৎজ্যোতিকে যে এখন কেউ চেনেই না তার প্রমাণ হচ্ছে যে তার মৃত্যু দিবসে কেউ একটু আহা উহুও করে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চুপ। আমি কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই মহাবীরকে স্মরণ করতে শুনিনি। তিনি যে স্কুলে লেখাপড়া করেছেন যে এলাকায় তার বাড়ি এবং যে এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেছেন তাদের কেউ তাকে স্মরণে রাখার মতো কোন কর্মকা- করেন না। কদিন আগে আজমিরীগঞ্জ থেকে একটি পাঠাগারের চিঠি আমার কাছে আসে যাতে পাঠাগারটির নাম জগৎজ্যোতি বলে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার এত সময় পরেও শুধু বইয়ের পাতায় বা অনলাইনে একজন জাতীয় বীরের বিবরণ সীমিত থাকবে সেটি প্রত্যাশিত নয়। যে সময়ে দেশে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে সেই মুহূর্তে আমরা এই প্রত্যাশাটি করতেই পারি যে এই বীর তার প্রাপ্য সম্মান পাবে। আমি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নীতি-নির্ধারকদের সবার কাছে আবেদন জানাই যেন এই বীর পুরুষটিকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। নিজে হাওর এলাকার মানুষ হিসেবে আমি এটিও চাই যে এই এলাকার মানুষের কাছে জগৎজ্যোতি দাসের যুদ্ধ এবং তার বীরত্ব যেন তুলে ধরা হয়।

১৬১ রাজাকারের আত্মসমর্পণ : জগৎজ্যোতির শহীদ হওয়ার ৫০ বছর পার হওয়ার লগ্নে এই নিবন্ধের শেষ প্রান্তে একটি বিজয় এর কথা আমি উল্লেখ করতে পারি। আমরা সবাই জানি ১৬ নভেম্বর ৭১ জগৎজ্যোতি শহীদ হওয়ার এক মাসের মাঝেই দেশটি স্বাধীন হয়। ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্যসহ পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করলেও তারা এমনকি তাদের দালালদের দিকে নজরও দেয়নি। শাল্লা থানায় যেসব রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তান বাহিনীর পদলেহন করেছিল তারা পরাজয়ের পর আত্মগোপন করে। শাল্লার পাশের থানা বলে ১৬১ জনের সেই রাজাকারবাহিনী আমাদের থানা খালিয়াজুরিতে বিভিন্ন গ্রামে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শাল্লার সদর দপ্তর ঘুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে।

তাই ভয়ে ওরা সেই থানায় যাওয়ার কথা ভাবেওনি। কিন্তু যখন টের পেল যে পাকিস্তানের পতন হয়েছে এবং আর কোন ভরসাও নাই তখন আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। আমি তখন আমার থানা খালিয়াজুরীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লিপ্সায়। লিপ্সা একটি হাট। সেখানকার কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের গুদামে আমরা ঘাঁটি তৈরি করি। আমি মহেশখলা থেকে লিপ্সা আসি ৬ ডিসেম্বর ৭১। সঙ্গে একটা গ্রেনেড ছিল। সেটি ক্যাম্পে জমা দিই। ৭২ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার গ্রামের বাড়ি কৃষ্ণপুর থেকে আব্বাস আলী নামক আমার এক চাচা একটি টেলিগ্রাম, একটি চিঠি ও আব্বার একটি নির্দেশ বহন করে আনেন। টেলিগ্রামটি ছিল আফতাব আহমদ নামক আমার এক প্রয়াত বন্ধুর। সে লিখেছিল, কাম শার্প-আফতাব। ঢাকা থেকে পাঠানো সেই টেলিগ্রামটি আমার ঢাকা ফেরার রাস্তা গড়ে তুলে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমরা দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন ছিলাম।

তারপর জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না

চিঠিটি ছিল সহপাঠিনী রোকসানা সুলতানার; কেমন আছি সেটি জানার জন্য সেই পত্র। বাবার আদেশটি ছিল গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। বাবার আদেশ মানতে গিয়ে সম্ভবত চাচার সঙ্গে ১৩ জানুয়ারি বাড়ি এসে জানতে পারি যে, শাল্লা থানার খালেক ও সরাফত চেয়ারম্যানের রাজাকাররা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। আমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কাশেমকেও তারা আমার সঙ্গে দেখতে চায়। কাশেম যেহেতু শাল্লার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছিল সেহেতু তাকেও খবর দিয়ে আনা হয়। কাশেমদের বাড়িতেই অস্ত্র সমর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়। কাশেমরা সুলতানপুর ও শ্যামার চরের দুই চেয়ারম্যানেরই আত্মীয় ছিল। তাই তারা অনেক ভরসা করে তাদের বাড়িটাকেই নিরাপদ মনে করে। রাজাকাররা দল বেঁধে কাশেমদের বাড়িতে আমার হাতে সব অস্ত্র সমর্পণ করে।

ওদের অনুরোধ ছিল আমি যেন তাদের লিপ্সা নিয়ে যাই। কিন্তু ওদের আত্মসমর্পণের পর আমি তাদের এবং অস্ত্রগুলোকে শাল্লা পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমার বাবা পীর আব্দুল জব্বার তালুকদার, ভাই ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও আমার ভাগিনা প্রয়াত আবিদ মাস্টার তাদের আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের ঘুঙ্গিয়ার গাও এ নিয়ে যায়। আমি লিপ্সার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রাজাকারদের পাঠাতে চাইনি। এর দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তারা শাল্লার রাজাকার তাদের শাল্লাই পাঠানো সঠিক। দ্বিতীয়ত, আমি ঢাকা আসব, লিপ্সা যাব না, তাই লিপ্সা নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এলাকার লোকজন পরে জানিয়েছে সেই দিনটি ছিল হাটবার-শনিবার-সম্ভবত ১৪ জানুয়ারি ৭২। পরের দিন সকালে আমি আজমিরীগঞ্জ হেঁটে আসি ও ভৈরব হয়ে ১৬ জানুয়ারি ৭২ ঢাকা পৌঁছাই। এর কয়েকদিন পর শাল্লার ঘটনা আমি জানতে পারি। ১৫ জানুয়ারিই তাদের শাল্লা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই রাতেই তাদের পাশের ভেরামোহনা নদীর পারে নিয়ে যাওয়া হয়।

শাল্লায় তখন ক্যাম্পের দায়িত্ব সুকুমার দাসের হাতে। রাজাকাররা শাল্লা পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে। এরপর তাদের সভার নামে একসঙ্গে জড়ো করা হয়। সেই সভা থেকেই তাদের ভেরামোহনা নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। সেখানে থেকে কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচে। তবে মূল নেতা দুই চেয়ারম্যানসহ তাদের স্বজনগণ ও নেতাগুলো সবই মারা যায়। একজন রাজাকার শশারকান্দার সিদ্দিক মাস্টার আমাকে পেরুয়া গণহত্যার অপরাধে জানায় যে ওই রাতে ৮১ জন নিহত হয় ও সে সহ ৮০ জন পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশেষত বর্ষা আসার পর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও ওরফে শাল্লা থানার হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘর বাড়ি ও সম্পদ হারায়। যুদ্ধের পর তারা সর্বস্বহীন শ্মশান বাড়িতে পা রাখে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই সান্ত¡নার জায়গাটুকু প্রদান করতে সক্ষম হয় যে অত্যাচারের পতন কোন না কোনভাবে হয়ই।

আমার জানামতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমনি জগৎজ্যোতির মতো বীর আমরা খুব বেশি পাইনি তেমনি রাজাকারদের তাদের কৃতকর্মের শাস্তিও তেমনভাবে আর কোথাও দেয়া যায়নি।

এই ঘটনার বহু বছর পর আমি সুকুমারের খোঁজ করছিলাম। কিন্তু তার কোন খোঁজ আমি আর পাইনি। কাশেম মুক্তিযুদ্ধের পর ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করার পর টঙ্গীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে এখন টঙ্গীতেই অবসর জীবনযাপন করে।

আমি কাশেমের কাছে শাল্লার ঘটনার বিবরণ জানতে চেয়েও হতাশ হয়েছি। কোন বিষয়েই কাশেম কোন কথা বলে না। কাশেম মুখ খোলেনি এজন্য যে তার জন্য বিষয়টি অপ্রীতিকর।

আমার জানা মতে যেমনি জগৎজ্যোতির বীরত্ব এর সমতূল্য কোন ঘটনা অন্তত হাওর অঞ্চলে নেই তেমনি শাল্লার রাজাকারদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনাও আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সুকুমার এখন আর এদেশে নেই ভারত চলে গেছে। (সমাপ্ত)

সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৭ নভেম্বর, ২০২১।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জগৎজ্যোতি দাস : ইতিহাসের বীরশ্রেষ্ঠ

মোস্তাফা জব্বার

সোমবার, ২৯ নভেম্বর ২০২১

তিন

বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসকে নিয়ে লেখাটির পরের অংশ শুরু হয়েছে এভাবে, “নিষ্ঠুরের মতো ইলিয়াসের ঘোর ভাঙেন হাসান মুর্শেদ। প্রশ্ন করেন, “তারপর কি হলো ইলিয়াস ভাই?” ইলিয়াস বলেন সেই অসম্ভব যন্ত্রণার গল্প। প্রিয় কমান্ডারের নিথর শরীর বিলের কাদা পানির ভেতর যতটা সম্ভব পুঁতে ফেলতে হয় তাকে, যেন শত্রুর হাতে এই বীরের কোন অবমাননা না হয়। নিজের এসএমজিটার সঙ্গে তুলে নেন দলনেতার এলএমজিটাও। বুকে বাঁধা গামছা থেকে চুইয়ে পড়তে থাকা রক্ত উপেক্ষা করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পেছনে ফিরতে থাকেন ইলিয়াস।

ইলিয়াসের চেষ্টাটুকু সফল হয় না। পরদিন সকালে লাশ কাদা-পানি ভেতর দিয়ে ভেসে ওঠে। রাজাকার তেলাপোকাগুলো বেরিয়ে আসে তখন, টেনে-হিঁচড়ে লাশটা নিয়ে আসে তাদের ঘাঁটটিতে। তারপর জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না, জ্যোতির বাম হাতে একটা আঙ্গুল বেশি।

কেন জ্যোতির মা সন্তানের লাশকে অগ্রাহ্য করেছিলেন? মা হয়ে কীভাবে এ সাহস করলেন তিনি? তিনি কি তখন তার স্বামী আর বেঁচে থাকা অপর সন্তানের জীবন বাঁচানোর কথা ভাবছিলেন? জানা যাবে না আর কখনোই। মারা গেছেন তিনি ক’বছর আগে।

তাতে খুব বেশি লাভ হলো না। বাড়ি ফিরে যেতে যেতে জ্যোতির বাবা-মা দেখলেন, তাদের ভিটায় আগুন, জ্বলছে সব। ওদিকে নর্দমার ময়লায় লুকিয়ে থাকা রাজাকার তেলাপোকাগুলো জ্যোতির লাশটা নৌকার সামনে বেঁধে নিল, আজমিরীগঞ্জ থেকে জলসুখা পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে উৎকট উৎসাহের সঙ্গে প্রদর্শন করল ‘গাদ্দার’-এর লাশ, পৈশাচিক উল্লাসে।

তারপর আজমিরীগঞ্জ পৌঁছে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত লাশটা বেঁধে রাখল তারা, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে জানালো, এই হচ্ছে সেই কুখ্যাত ভারতীয় দালাল, গাদ্দার...”

হাসান মুর্শেদের দেয়া তথ্য থেকে আরও জানা যায় যে, “১৬ নভেম্বর জগৎজ্যোতির মৃত্যুদিন। প্রথম বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার কথা ছিল জগৎজ্যোতি দাসের, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জগৎজ্যোতির মৃত্যুর পর তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বভূষণ দেবার কথা বলা হয়েছিল বারবার, কিন্তু অব্যাখ্যানীয় কোন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি, বীরশ্রেষ্ঠ তো দূরে থাক, ভাটি অঞ্চলের কিংবদন্তি জগৎজ্যোতিকে আজ প্রায় কেউই চেনে না।”

জগৎজ্যোতিকে যে এখন কেউ চেনেই না তার প্রমাণ হচ্ছে যে তার মৃত্যু দিবসে কেউ একটু আহা উহুও করে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চুপ। আমি কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই মহাবীরকে স্মরণ করতে শুনিনি। তিনি যে স্কুলে লেখাপড়া করেছেন যে এলাকায় তার বাড়ি এবং যে এলাকায় তিনি যুদ্ধ করেছেন তাদের কেউ তাকে স্মরণে রাখার মতো কোন কর্মকা- করেন না। কদিন আগে আজমিরীগঞ্জ থেকে একটি পাঠাগারের চিঠি আমার কাছে আসে যাতে পাঠাগারটির নাম জগৎজ্যোতি বলে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার এত সময় পরেও শুধু বইয়ের পাতায় বা অনলাইনে একজন জাতীয় বীরের বিবরণ সীমিত থাকবে সেটি প্রত্যাশিত নয়। যে সময়ে দেশে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে সেই মুহূর্তে আমরা এই প্রত্যাশাটি করতেই পারি যে এই বীর তার প্রাপ্য সম্মান পাবে। আমি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নীতি-নির্ধারকদের সবার কাছে আবেদন জানাই যেন এই বীর পুরুষটিকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। নিজে হাওর এলাকার মানুষ হিসেবে আমি এটিও চাই যে এই এলাকার মানুষের কাছে জগৎজ্যোতি দাসের যুদ্ধ এবং তার বীরত্ব যেন তুলে ধরা হয়।

১৬১ রাজাকারের আত্মসমর্পণ : জগৎজ্যোতির শহীদ হওয়ার ৫০ বছর পার হওয়ার লগ্নে এই নিবন্ধের শেষ প্রান্তে একটি বিজয় এর কথা আমি উল্লেখ করতে পারি। আমরা সবাই জানি ১৬ নভেম্বর ৭১ জগৎজ্যোতি শহীদ হওয়ার এক মাসের মাঝেই দেশটি স্বাধীন হয়। ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজার সৈন্যসহ পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে। ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করলেও তারা এমনকি তাদের দালালদের দিকে নজরও দেয়নি। শাল্লা থানায় যেসব রাজাকাররা অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পাকিস্তান বাহিনীর পদলেহন করেছিল তারা পরাজয়ের পর আত্মগোপন করে। শাল্লার পাশের থানা বলে ১৬১ জনের সেই রাজাকারবাহিনী আমাদের থানা খালিয়াজুরিতে বিভিন্ন গ্রামে তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। শাল্লার সদর দপ্তর ঘুঙ্গিয়ার গাঁওয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে।

তাই ভয়ে ওরা সেই থানায় যাওয়ার কথা ভাবেওনি। কিন্তু যখন টের পেল যে পাকিস্তানের পতন হয়েছে এবং আর কোন ভরসাও নাই তখন আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। আমি তখন আমার থানা খালিয়াজুরীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প লিপ্সায়। লিপ্সা একটি হাট। সেখানকার কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের গুদামে আমরা ঘাঁটি তৈরি করি। আমি মহেশখলা থেকে লিপ্সা আসি ৬ ডিসেম্বর ৭১। সঙ্গে একটা গ্রেনেড ছিল। সেটি ক্যাম্পে জমা দিই। ৭২ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমার গ্রামের বাড়ি কৃষ্ণপুর থেকে আব্বাস আলী নামক আমার এক চাচা একটি টেলিগ্রাম, একটি চিঠি ও আব্বার একটি নির্দেশ বহন করে আনেন। টেলিগ্রামটি ছিল আফতাব আহমদ নামক আমার এক প্রয়াত বন্ধুর। সে লিখেছিল, কাম শার্প-আফতাব। ঢাকা থেকে পাঠানো সেই টেলিগ্রামটি আমার ঢাকা ফেরার রাস্তা গড়ে তুলে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস আমরা দুই বন্ধু বিচ্ছিন্ন ছিলাম।

তারপর জগৎজ্যোতির মা-বাবাকে লাশের সামনে টেনে আনলো ওরা। পাথরের মতো পাষাণ হয়ে মা বললেন, এই লাশ তার জ্যোতির না

চিঠিটি ছিল সহপাঠিনী রোকসানা সুলতানার; কেমন আছি সেটি জানার জন্য সেই পত্র। বাবার আদেশটি ছিল গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। বাবার আদেশ মানতে গিয়ে সম্ভবত চাচার সঙ্গে ১৩ জানুয়ারি বাড়ি এসে জানতে পারি যে, শাল্লা থানার খালেক ও সরাফত চেয়ারম্যানের রাজাকাররা আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। আমার গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা কাশেমকেও তারা আমার সঙ্গে দেখতে চায়। কাশেম যেহেতু শাল্লার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে ছিল সেহেতু তাকেও খবর দিয়ে আনা হয়। কাশেমদের বাড়িতেই অস্ত্র সমর্পণ করার ব্যবস্থা করা হয়। কাশেমরা সুলতানপুর ও শ্যামার চরের দুই চেয়ারম্যানেরই আত্মীয় ছিল। তাই তারা অনেক ভরসা করে তাদের বাড়িটাকেই নিরাপদ মনে করে। রাজাকাররা দল বেঁধে কাশেমদের বাড়িতে আমার হাতে সব অস্ত্র সমর্পণ করে।

ওদের অনুরোধ ছিল আমি যেন তাদের লিপ্সা নিয়ে যাই। কিন্তু ওদের আত্মসমর্পণের পর আমি তাদের এবং অস্ত্রগুলোকে শাল্লা পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমার বাবা পীর আব্দুল জব্বার তালুকদার, ভাই ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ ও আমার ভাগিনা প্রয়াত আবিদ মাস্টার তাদের আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের ঘুঙ্গিয়ার গাও এ নিয়ে যায়। আমি লিপ্সার মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রাজাকারদের পাঠাতে চাইনি। এর দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তারা শাল্লার রাজাকার তাদের শাল্লাই পাঠানো সঠিক। দ্বিতীয়ত, আমি ঢাকা আসব, লিপ্সা যাব না, তাই লিপ্সা নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এলাকার লোকজন পরে জানিয়েছে সেই দিনটি ছিল হাটবার-শনিবার-সম্ভবত ১৪ জানুয়ারি ৭২। পরের দিন সকালে আমি আজমিরীগঞ্জ হেঁটে আসি ও ভৈরব হয়ে ১৬ জানুয়ারি ৭২ ঢাকা পৌঁছাই। এর কয়েকদিন পর শাল্লার ঘটনা আমি জানতে পারি। ১৫ জানুয়ারিই তাদের শাল্লা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই রাতেই তাদের পাশের ভেরামোহনা নদীর পারে নিয়ে যাওয়া হয়।

শাল্লায় তখন ক্যাম্পের দায়িত্ব সুকুমার দাসের হাতে। রাজাকাররা শাল্লা পৌঁছালে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে। এরপর তাদের সভার নামে একসঙ্গে জড়ো করা হয়। সেই সভা থেকেই তাদের ভেরামোহনা নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। সেখানে থেকে কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচে। তবে মূল নেতা দুই চেয়ারম্যানসহ তাদের স্বজনগণ ও নেতাগুলো সবই মারা যায়। একজন রাজাকার শশারকান্দার সিদ্দিক মাস্টার আমাকে পেরুয়া গণহত্যার অপরাধে জানায় যে ওই রাতে ৮১ জন নিহত হয় ও সে সহ ৮০ জন পালিয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশেষত বর্ষা আসার পর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও ওরফে শাল্লা থানার হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘর বাড়ি ও সম্পদ হারায়। যুদ্ধের পর তারা সর্বস্বহীন শ্মশান বাড়িতে পা রাখে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই সান্ত¡নার জায়গাটুকু প্রদান করতে সক্ষম হয় যে অত্যাচারের পতন কোন না কোনভাবে হয়ই।

আমার জানামতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেমনি জগৎজ্যোতির মতো বীর আমরা খুব বেশি পাইনি তেমনি রাজাকারদের তাদের কৃতকর্মের শাস্তিও তেমনভাবে আর কোথাও দেয়া যায়নি।

এই ঘটনার বহু বছর পর আমি সুকুমারের খোঁজ করছিলাম। কিন্তু তার কোন খোঁজ আমি আর পাইনি। কাশেম মুক্তিযুদ্ধের পর ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করার পর টঙ্গীর একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে এখন টঙ্গীতেই অবসর জীবনযাপন করে।

আমি কাশেমের কাছে শাল্লার ঘটনার বিবরণ জানতে চেয়েও হতাশ হয়েছি। কোন বিষয়েই কাশেম কোন কথা বলে না। কাশেম মুখ খোলেনি এজন্য যে তার জন্য বিষয়টি অপ্রীতিকর।

আমার জানা মতে যেমনি জগৎজ্যোতির বীরত্ব এর সমতূল্য কোন ঘটনা অন্তত হাওর অঞ্চলে নেই তেমনি শাল্লার রাজাকারদের শাস্তি পাওয়ার ঘটনাও আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সুকুমার এখন আর এদেশে নেই ভারত চলে গেছে। (সমাপ্ত)

সর্বশেষ সম্পাদনা : ২৭ নভেম্বর, ২০২১।

[লেখক : ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী]

back to top