alt

উপ-সম্পাদকীয়

গণমাধ্যমের শিরদাঁড়া

এমএ কবীর

: শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২

এখন সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে পাঠকের চেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপন বাড়াবার জন্য পাঠকপ্রিয়তার প্রয়োজন হয়, তবে বিজ্ঞাপনই হচ্ছে লক্ষ্য, পাঠক-প্রাপ্তি বিজ্ঞাপন বৃদ্ধির উপায়। বিজ্ঞাপন যদিও লক্ষ্য, তবু পাঠক না থাকলে বিজ্ঞাপন আসবে না। আর বিজ্ঞাপন না এলে সংবাদপত্রও চলবে না। পাঠককে তাই উপেক্ষা করার উপায় নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকার ও ব্যবসায়ীদের হাতে, তবে কিছুটা হলেও পাঠকের হাতেও।

সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের প্রত্যাশাটা খুবই সাধারণ। পাঠক সংবাদ চায়। কিন্তু সংবাদ তো নানা ধরনের হয়। পাঠক চায় তার নিজের পক্ষের সংবাদ। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার কথাটা খুব চালু আছে। নিরপেক্ষতা কিন্তু মোটেই সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে কেউ যদি বলেন তিনি কোনো পক্ষে নেই, তিনি নিরপেক্ষ; তাহলে বুঝতে হবে জ্ঞাতে হোক কি অজ্ঞাতেই হোক তিনি প্রতারণা করছেন, অপরের সঙ্গে তো অবশ্যই, নিজের সঙ্গেও হয়তো। পাঠক চায় সংবাদপত্র থাকবে ন্যায়ের পক্ষে এবং পাঠক মনে করে যে সে নিজেও ন্যায়ের পক্ষেই রয়েছে।

কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে যাওয়াটা তো সহজ নয়। কারণ অন্যায় অত্যন্ত শক্তিশালী। রাষ্ট্র ও সমাজ অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কেবল তাই নয়, ওই দুই ব্যবস্থা নিজেরাও অন্যায় করে। আর সংবাদপত্র নিজেও জানে এবং মানে যে সে এসেছে ব্যবসা করতে। ব্যবসা করতে গেলে সামাজিক শাসন মান্য করাটা ভালো, আর রাষ্ট্রকে চটানো তো কোনো মতেই উচিত নয়। চটানো আসলে সম্ভবও নয়। কারণ রাষ্ট্র উত্ত্যক্ত হওয়া পছন্দ করে না, ইশারায় নিষেধ করে, না শুনলে গলা চেপে ধরে। সংবাদপত্র পাঠকের কাছে যেতে চায়,পাঠকের জন্যই তো তার আত্মপ্রকাশ, কিন্তু সংবাদপত্রকে চোখ রাখতে হয় রাষ্ট্রের দিকে। রাষ্ট্র আবার সমাজেরও রক্ষক। রাষ্ট্র প্রকাশ পায় সরকারের মধ্য দিয়ে, সংবাদপত্র তাই সরকারকে মেনে চলে।

সংবাদপত্র জনপ্রিয় হতে চায়, কিন্তু ভয় পায় সরকারের অপ্রিয় হতে। পাঠক পছন্দ করে অপরাধের খবর। ফৌজদারি অপরাধ হলে পাঠকের রসনাতৃপ্ত হয়; রাজনৈতিক অপরাধও কম সুস্বাদু নয়। এর ভেতরের রহস্যটা অবশ্য এই যে পাঠকের রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের বড় একটা ভূমিকা থাকে। পাঠক আসলে অপরাধের খবর চায় না, তাকে ওই খবর সরবরাহ করে আসক্তি তৈরি করা হয়, যার ফলে সে পছন্দের আর ওই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। অপরাধের খবরই তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। খোরাক না পেলে ভেতরে ভেতরে সে হতাশ হয়।

প্রকৃত খবর হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাটা এখন ভয়ঙ্করভাবে অসুস্থ। এরা উভয়েই অপরাধী। রাষ্ট্র ও সমাজের অসুখের কারণেই নাগরিকরা অসুস্থ। এই নাগরিকরাই তো সংবাদপত্রের পাঠক। তারা আশার খবর চায়। আশার খবর মানে কি? সেটা হলো অপরাধীর শাস্তির খবর। অপরাধ যে নির্মূল হবে পাঠক চায় এ রকম আশ্বাসও। কিন্তু অপরাধীর শাস্তির খবর তো পাওয়া যায় না। অপরাধের খবর পাওয়া যায়, কিন্তু অপরাধীর কী শাস্তি হলো সেটা জানা যায় না। নতুন অপরাধের খবর এসে অপরাধের পুরনো খবরকে ম্লান করে দেয়। আর মূল যে অপরাধী, রাষ্ট্র ও সমাজ- তারা তো চিহ্নিতই হয় না। রাষ্ট্র ও সমাজের শাস্তিটা অন্য কিছু নয়, রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন আনা ভিন্ন। মানুষ লড়ছে ব্যবস্থা বদলাবার জন্য এবং ব্যবস্থা বদলাবে বৈকি। কিন্তু সেসব খবর পত্রিকায় আসে না। ওই বিষয়ে খবরকে উপেক্ষা করা হয়,কখনো কখনো বিকৃতও করা হয়। কারণ সংবাদপত্রের যারা মালিক তারা ব্যবস্থার পক্ষে থাকেন। ব্যবস্থা তাদের সুবিধা দেয়। ব্যবস্থাটা বদলে গেলে তাদের ভীষণ অসুবিধা, আম ও ছালা একসঙ্গে লোপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এমন কি সাধারণ যে অপরাধগুলো, যাদের রমরমা বর্ণনা পাঠককে আমোদ, আরাম ইত্যাদি দিতে চায় সেগুলোর অভ্যন্তরে যে রহস্য রয়েছে, যেসব কার্যকারণে তারা সংঘটিত, তাদেরও উন্মোচন ঘটে না। অন্ধকার অন্ধকারেই রয়ে যায়; অপরাধ বাড়তে থাকে- সংখ্যায় যেমন, মাত্রাতেও তেমন। ভেতরে অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনাগ্রহটা চমৎকারভাবে প্রকাশ পায় পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। সম্পাদকীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; সেখানে থাকবার কথা পত্রিকাটির অবস্থানের হদিস। গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কেবল খবর দেয়ার দক্ষতার কারণে নয়; সঙ্গে থাকে খবরের ব্যাখ্যাও। সেটা খবরে থাকবে, থাকবে সম্পাদকীয়তে। ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য গভীরে যেতে হয়; প্রয়োজন হয় জ্ঞানের ও গবেষণার; এবং স্থির থাকতে হয় দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিতে। সমসাময়িক বিশে^ ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চরম ফ্যাসিবাদী ভীতির সঞ্চার করেন তাতে রক্ষণশীলরা পর্যন্ত প্রমাদ গুনেছেন, আশঙ্কা করছেন ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে, নৈরাজ্য দেখা দেবে। রক্ষণশীল পত্রিকাগুলোও তাই ট্রাম্পের সমালোচনা করে। সেই সমালোচনা বিশেষভাবে প্রকাশ পায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সবচেয়ে কম পঠিত অংশ হলো সম্পাদকীয়। দায়সারাভাবে লেখা হয়, রাখতে হয় তাই যেন রাখা। সত্য উন্মোচন থাকে না, ব্যাখ্যা আসে না ঘটনাবলির, দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পাওয়া যায় না। বক্তব্য থাকে নিষ্প্রাণ, লেখার ধরন যান্ত্রিক। অনেক কথা বলা হয়, কোন কথা না-বলে। ফলে পড়ার আগেই পাঠক অনুমান করতে পারেন ভেতরে কী আছে। সে-অনুমান যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এমন নয়। উপসম্পাদকীয়ের ব্যাপারেও একই কথা। পাঠক লেখকের নাম দেখে এবং বুঝে নেয় ভেতরে কী আছে। চোখ বুলায়, পড়তে আগ্রহী হয় না। সম্পাদকীয় পাতাতে জনমতের প্রতিফলন থাকবার কথা চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে। চিঠিপত্রও আসে না, চিঠিপত্রকে যে উৎসাহ দেয়া হয় এমন নয়।

২০২১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। কারণ এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। সে হিসেবে বছরটি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে আসলেই কি গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ কিছু?

পাঠকের জন্য সংবাদপত্রের একটা বড় আকর্ষণ হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্র। ব্যঙ্গচিত্র সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর কৌতুককর মন্তব্য থাকে। সেখানে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পায়। পত্রিকা থেকে ব্যঙ্গচিত্র উঠেই গেছে। কৌতুক দেয়ার জন্য নানা রকম অসংগতি থাকে, সেগুলো আড্ডাবাজির মতোই অর্থহীন। দাগ কাটে না, কৌতুকের সৃষ্টি করে না। আর আছে রং ঢং। মানুষের জীবনে রঙের অভাব, পত্রিকাগুলো আসে রঙিন হয়ে। ফটো জার্নালিজমও গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ ফটোগ্রাফাররা আছেন, তারা ছবিও তোলেন, কিন্তু অনেক ছবিই ছাপা হয় না। নইলে ছবিগুলো এমন গতানুগতিক হবে কেন? যেমন, সরকারবিরোধী আন্দোলন, সংগ্রাম এবং হরতালের সময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে, সেগুলোর ছবি কাগজে আসে না। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। সংবাদপত্রের পাতাতে সংবাদের জন্য বরাদ্দ জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের ধাক্কায়। বিজ্ঞাপন প্রথম পাতাকে পর্যন্ত গ্রাস করেছে। মালিকের চোখ বিজ্ঞাপনের দিকে। এখানে রয়েছে পুঁজিবাদের চরম প্রকাশ। খবরের কাগজের কাছে পাঠকের এত সব প্রত্যাশার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার, অর্থাৎ সরকারের ওপর সামাজিক নজরদারিত্বের অভাব। নজরদারিত্ব দরকার জবাবদিহিতা তৈরি করার জন্য। কাজটা আইন পরিষদের করার কথা। আইন পরিষদ সেটা করতে পারে না। কারণ সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সরকারি দলের, কাজেই যতই সমালোচনা হোক, সরকার তার ইচ্ছা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। নজরদারিত্ব করতে পারে বিচার বিভাগ। কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে অসমর্থ হয়। এজন্যই সংবাদপত্রের কাছে প্রত্যাশা থাকে যে তারা খবর দেবে, খবরের পেছনের খবর বের করে আনবে, সরকারের কাজের সমালোচনা করবে, জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে, এবং সহায়তা দেবে জনমত সংগঠনে। বড় প্রত্যাশা সংবাদপত্র পুঁজিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে বলবে। নদীতে ঢেউ থাকে, বালিও থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে বালুতে পরিণত করতে চায়, ঢেউকে বাদ দিয়ে। কারণ বালুকে পণ্য করা যায়, ঢেউকে তা করা যায় না। মানুষের প্রত্যাশা সংবাদপত্র ঢেউয়ের পক্ষে দাঁড়াবে। প্রত্যাশাটা বিশেষভাবে এই কারণে যে, বালুর দৌরাত্ম্য এখন সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। ঢেউগুলো কেবলি মার খাচ্ছে, বালুর হাতে, অর্থাৎ বালুর ব্যবসায়ীদের হাতে।

২০২১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। কারণ এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। সে হিসেবে বছরটি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে আসলেই কি গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ কিছু? নাকি গত এক দশকে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যবস্থার যে অবনমন লক্ষ্য করেছি তারই ধারাবাহিকতায় তথৈবচ সাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ? আমরা ২০২২ কে স্বাগত জানাই। প্রত্যাশা, সময়টা হোক গণমাধ্যমের শিরদাঁড়া সোজা করার বছর।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

গণমাধ্যমের শিরদাঁড়া

এমএ কবীর

শনিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২২

এখন সংবাদপত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে পাঠকের চেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞাপনের। বিজ্ঞাপন বাড়াবার জন্য পাঠকপ্রিয়তার প্রয়োজন হয়, তবে বিজ্ঞাপনই হচ্ছে লক্ষ্য, পাঠক-প্রাপ্তি বিজ্ঞাপন বৃদ্ধির উপায়। বিজ্ঞাপন যদিও লক্ষ্য, তবু পাঠক না থাকলে বিজ্ঞাপন আসবে না। আর বিজ্ঞাপন না এলে সংবাদপত্রও চলবে না। পাঠককে তাই উপেক্ষা করার উপায় নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকার ও ব্যবসায়ীদের হাতে, তবে কিছুটা হলেও পাঠকের হাতেও।

সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের প্রত্যাশাটা খুবই সাধারণ। পাঠক সংবাদ চায়। কিন্তু সংবাদ তো নানা ধরনের হয়। পাঠক চায় তার নিজের পক্ষের সংবাদ। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার কথাটা খুব চালু আছে। নিরপেক্ষতা কিন্তু মোটেই সম্ভব নয়। ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধটা প্রতিনিয়ত চলছে, সেখানে কেউ যদি বলেন তিনি কোনো পক্ষে নেই, তিনি নিরপেক্ষ; তাহলে বুঝতে হবে জ্ঞাতে হোক কি অজ্ঞাতেই হোক তিনি প্রতারণা করছেন, অপরের সঙ্গে তো অবশ্যই, নিজের সঙ্গেও হয়তো। পাঠক চায় সংবাদপত্র থাকবে ন্যায়ের পক্ষে এবং পাঠক মনে করে যে সে নিজেও ন্যায়ের পক্ষেই রয়েছে।

কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে যাওয়াটা তো সহজ নয়। কারণ অন্যায় অত্যন্ত শক্তিশালী। রাষ্ট্র ও সমাজ অন্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কেবল তাই নয়, ওই দুই ব্যবস্থা নিজেরাও অন্যায় করে। আর সংবাদপত্র নিজেও জানে এবং মানে যে সে এসেছে ব্যবসা করতে। ব্যবসা করতে গেলে সামাজিক শাসন মান্য করাটা ভালো, আর রাষ্ট্রকে চটানো তো কোনো মতেই উচিত নয়। চটানো আসলে সম্ভবও নয়। কারণ রাষ্ট্র উত্ত্যক্ত হওয়া পছন্দ করে না, ইশারায় নিষেধ করে, না শুনলে গলা চেপে ধরে। সংবাদপত্র পাঠকের কাছে যেতে চায়,পাঠকের জন্যই তো তার আত্মপ্রকাশ, কিন্তু সংবাদপত্রকে চোখ রাখতে হয় রাষ্ট্রের দিকে। রাষ্ট্র আবার সমাজেরও রক্ষক। রাষ্ট্র প্রকাশ পায় সরকারের মধ্য দিয়ে, সংবাদপত্র তাই সরকারকে মেনে চলে।

সংবাদপত্র জনপ্রিয় হতে চায়, কিন্তু ভয় পায় সরকারের অপ্রিয় হতে। পাঠক পছন্দ করে অপরাধের খবর। ফৌজদারি অপরাধ হলে পাঠকের রসনাতৃপ্ত হয়; রাজনৈতিক অপরাধও কম সুস্বাদু নয়। এর ভেতরের রহস্যটা অবশ্য এই যে পাঠকের রুচি তৈরিতে সংবাদপত্রের বড় একটা ভূমিকা থাকে। পাঠক আসলে অপরাধের খবর চায় না, তাকে ওই খবর সরবরাহ করে আসক্তি তৈরি করা হয়, যার ফলে সে পছন্দের আর ওই বৃত্তের বাইরে যেতে পারে না। অপরাধের খবরই তার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়। খোরাক না পেলে ভেতরে ভেতরে সে হতাশ হয়।

প্রকৃত খবর হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাটা এখন ভয়ঙ্করভাবে অসুস্থ। এরা উভয়েই অপরাধী। রাষ্ট্র ও সমাজের অসুখের কারণেই নাগরিকরা অসুস্থ। এই নাগরিকরাই তো সংবাদপত্রের পাঠক। তারা আশার খবর চায়। আশার খবর মানে কি? সেটা হলো অপরাধীর শাস্তির খবর। অপরাধ যে নির্মূল হবে পাঠক চায় এ রকম আশ্বাসও। কিন্তু অপরাধীর শাস্তির খবর তো পাওয়া যায় না। অপরাধের খবর পাওয়া যায়, কিন্তু অপরাধীর কী শাস্তি হলো সেটা জানা যায় না। নতুন অপরাধের খবর এসে অপরাধের পুরনো খবরকে ম্লান করে দেয়। আর মূল যে অপরাধী, রাষ্ট্র ও সমাজ- তারা তো চিহ্নিতই হয় না। রাষ্ট্র ও সমাজের শাস্তিটা অন্য কিছু নয়, রাষ্ট্র ও সমাজে পরিবর্তন আনা ভিন্ন। মানুষ লড়ছে ব্যবস্থা বদলাবার জন্য এবং ব্যবস্থা বদলাবে বৈকি। কিন্তু সেসব খবর পত্রিকায় আসে না। ওই বিষয়ে খবরকে উপেক্ষা করা হয়,কখনো কখনো বিকৃতও করা হয়। কারণ সংবাদপত্রের যারা মালিক তারা ব্যবস্থার পক্ষে থাকেন। ব্যবস্থা তাদের সুবিধা দেয়। ব্যবস্থাটা বদলে গেলে তাদের ভীষণ অসুবিধা, আম ও ছালা একসঙ্গে লোপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এমন কি সাধারণ যে অপরাধগুলো, যাদের রমরমা বর্ণনা পাঠককে আমোদ, আরাম ইত্যাদি দিতে চায় সেগুলোর অভ্যন্তরে যে রহস্য রয়েছে, যেসব কার্যকারণে তারা সংঘটিত, তাদেরও উন্মোচন ঘটে না। অন্ধকার অন্ধকারেই রয়ে যায়; অপরাধ বাড়তে থাকে- সংখ্যায় যেমন, মাত্রাতেও তেমন। ভেতরে অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনাগ্রহটা চমৎকারভাবে প্রকাশ পায় পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। সম্পাদকীয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; সেখানে থাকবার কথা পত্রিকাটির অবস্থানের হদিস। গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কেবল খবর দেয়ার দক্ষতার কারণে নয়; সঙ্গে থাকে খবরের ব্যাখ্যাও। সেটা খবরে থাকবে, থাকবে সম্পাদকীয়তে। ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য গভীরে যেতে হয়; প্রয়োজন হয় জ্ঞানের ও গবেষণার; এবং স্থির থাকতে হয় দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিতে। সমসাময়িক বিশে^ ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চরম ফ্যাসিবাদী ভীতির সঞ্চার করেন তাতে রক্ষণশীলরা পর্যন্ত প্রমাদ গুনেছেন, আশঙ্কা করছেন ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে, নৈরাজ্য দেখা দেবে। রক্ষণশীল পত্রিকাগুলোও তাই ট্রাম্পের সমালোচনা করে। সেই সমালোচনা বিশেষভাবে প্রকাশ পায় সম্পাদকীয় মন্তব্যে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রের সবচেয়ে কম পঠিত অংশ হলো সম্পাদকীয়। দায়সারাভাবে লেখা হয়, রাখতে হয় তাই যেন রাখা। সত্য উন্মোচন থাকে না, ব্যাখ্যা আসে না ঘটনাবলির, দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ পাওয়া যায় না। বক্তব্য থাকে নিষ্প্রাণ, লেখার ধরন যান্ত্রিক। অনেক কথা বলা হয়, কোন কথা না-বলে। ফলে পড়ার আগেই পাঠক অনুমান করতে পারেন ভেতরে কী আছে। সে-অনুমান যে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় এমন নয়। উপসম্পাদকীয়ের ব্যাপারেও একই কথা। পাঠক লেখকের নাম দেখে এবং বুঝে নেয় ভেতরে কী আছে। চোখ বুলায়, পড়তে আগ্রহী হয় না। সম্পাদকীয় পাতাতে জনমতের প্রতিফলন থাকবার কথা চিঠিপত্রের মধ্য দিয়ে। চিঠিপত্রও আসে না, চিঠিপত্রকে যে উৎসাহ দেয়া হয় এমন নয়।

২০২১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। কারণ এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। সে হিসেবে বছরটি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে আসলেই কি গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ কিছু?

পাঠকের জন্য সংবাদপত্রের একটা বড় আকর্ষণ হচ্ছে ব্যঙ্গচিত্র। ব্যঙ্গচিত্র সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ওপর কৌতুককর মন্তব্য থাকে। সেখানে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পায়। পত্রিকা থেকে ব্যঙ্গচিত্র উঠেই গেছে। কৌতুক দেয়ার জন্য নানা রকম অসংগতি থাকে, সেগুলো আড্ডাবাজির মতোই অর্থহীন। দাগ কাটে না, কৌতুকের সৃষ্টি করে না। আর আছে রং ঢং। মানুষের জীবনে রঙের অভাব, পত্রিকাগুলো আসে রঙিন হয়ে। ফটো জার্নালিজমও গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষ ফটোগ্রাফাররা আছেন, তারা ছবিও তোলেন, কিন্তু অনেক ছবিই ছাপা হয় না। নইলে ছবিগুলো এমন গতানুগতিক হবে কেন? যেমন, সরকারবিরোধী আন্দোলন, সংগ্রাম এবং হরতালের সময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে, সেগুলোর ছবি কাগজে আসে না। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা কাজ করে। সংবাদপত্রের পাতাতে সংবাদের জন্য বরাদ্দ জায়গা সঙ্কুচিত হচ্ছে, বিজ্ঞাপনের ধাক্কায়। বিজ্ঞাপন প্রথম পাতাকে পর্যন্ত গ্রাস করেছে। মালিকের চোখ বিজ্ঞাপনের দিকে। এখানে রয়েছে পুঁজিবাদের চরম প্রকাশ। খবরের কাগজের কাছে পাঠকের এত সব প্রত্যাশার কারণটা কী? কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার, অর্থাৎ সরকারের ওপর সামাজিক নজরদারিত্বের অভাব। নজরদারিত্ব দরকার জবাবদিহিতা তৈরি করার জন্য। কাজটা আইন পরিষদের করার কথা। আইন পরিষদ সেটা করতে পারে না। কারণ সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে সরকারি দলের, কাজেই যতই সমালোচনা হোক, সরকার তার ইচ্ছা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। নজরদারিত্ব করতে পারে বিচার বিভাগ। কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে অসমর্থ হয়। এজন্যই সংবাদপত্রের কাছে প্রত্যাশা থাকে যে তারা খবর দেবে, খবরের পেছনের খবর বের করে আনবে, সরকারের কাজের সমালোচনা করবে, জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে, এবং সহায়তা দেবে জনমত সংগঠনে। বড় প্রত্যাশা সংবাদপত্র পুঁজিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে বলবে। নদীতে ঢেউ থাকে, বালিও থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষকে বালুতে পরিণত করতে চায়, ঢেউকে বাদ দিয়ে। কারণ বালুকে পণ্য করা যায়, ঢেউকে তা করা যায় না। মানুষের প্রত্যাশা সংবাদপত্র ঢেউয়ের পক্ষে দাঁড়াবে। প্রত্যাশাটা বিশেষভাবে এই কারণে যে, বালুর দৌরাত্ম্য এখন সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে। ঢেউগুলো কেবলি মার খাচ্ছে, বালুর হাতে, অর্থাৎ বালুর ব্যবসায়ীদের হাতে।

২০২১ ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক। কারণ এ বছর আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছি। সে হিসেবে বছরটি স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে আসলেই কি গণমাধ্যমের জন্য বিশেষ কিছু? নাকি গত এক দশকে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যম ব্যবস্থার যে অবনমন লক্ষ্য করেছি তারই ধারাবাহিকতায় তথৈবচ সাংবাদিকতার বহিঃপ্রকাশ? আমরা ২০২২ কে স্বাগত জানাই। প্রত্যাশা, সময়টা হোক গণমাধ্যমের শিরদাঁড়া সোজা করার বছর।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top