alt

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষক হত্যা : নৈতিক অবক্ষয়ের কদর্য রূপ

মাহমুদুল হাছান

: শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২

আমরা হতবাক, আমরা স্তম্ভিত, লজ্জায় আমরা হতবিহ্বল! শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে নিজ হাতে খুন করেছে! শিক্ষকেরা জাতির বিবেক ও মানুষ গড়ার কারিগর। উৎপল কুমার স্যার কি করেছিলেন কথিত শিক্ষার্থীর সঙ্গে, শাসন করেছিলেন, অশালীন কাজ থেকে বিরিত রাখতে চেয়েছিলেন, তাই তো? যে কাজ বাবা-মা করার কথা সেটি তিনিই করেছিলেন, এটিই কি তার অপরাধ? অথচ একজন শিক্ষক, শিক্ষার্থীর আধ্যাত্মিক পিতা-মাতা, যিনি শিক্ষার্থীদের আদর-স্নেহ করেন, আবার শাসন করেন আদর্শ মানুষ বানাতে। কিন্তু আফসোস! শিক্ষকদের হত্যা আর অপমানের মাধ্যমে এ আদর্শেরই হত্যা হলো।

এ দেশে শিক্ষক হত্যার ঘটনা এর আগে যে ঘটেনি, তা নয়। তাছাড়া, শিক্ষকদের অপমান, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বঞ্চনা অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি তো হরহামেশাই হচ্ছে। ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতনের জঘন্য চিত্র। এ ঘটনা নিছক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ব্যাপার নয়। একে দেখতে হবে সমাজব্যবস্থার প্রগতির বাধা হিসেবে। একে দেখতে হবে, সমাজকে পিছিয়ে টেনে নেয়ার লক্ষণ হিসেবে।

আমরা সম্ভবত আমাদের নৈতিক বিপর্যয়ের চরম সীমায় অবস্থান করছি; নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। অনৈতিক ভাবেই, আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছি।

দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলছে; যার লাগাম না টানলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। এখনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাব।

যে দেশে দিনের আলোয় জনসম্মুক্ষে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে অপমান করছে, নৃশংসভাবে হত্যা করছে, যার বিচার করার ক্ষমতা কারোর নেই, সে দেশের মানুষের নৈতিকতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা আমরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থার গলদের কারণে আমাদের নৈতিকতার আজ এ বিপর্যয় ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। আমাদের দেশের পিতা-মাতারা সন্তানকে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করে থাকেন; কিন্তু সে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা তার চেষ্টা আমরা কতটুকু করি?

আমরা শুধু সন্তানদের জিপিএ-৫ পাওয়ার পেছনে ছুটে বেড়াই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, পাঠ্যসূচিতে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় খুব কমই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সন্তানদের শিশু বয়স থেকেই বইয়ের ভারে নুইয়ে ফেলি, তারা মেধাবী হয় ঠিকই; কিন্তু একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠে না।

নৈতিকতা বিপর্যয়ের ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। এজন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা ও প্রয়োগ। শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বাস্তবায়ন কৌশল থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি। জাপানিরা নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুশৃঙ্খল অমায়িক চরিত্রের অধিকারী একটি জাতি হিসেবে পরিচিত। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা। তাদের বিশ্বাস, আগে নীতি-নৈতিকতা, পরে পাঠ্য শিক্ষা। জাপানে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত কোনো ধরনের পুঁথিগত বিষয়ে পরীক্ষা না নিয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক বিকাশের দিকেই বিশেষভাবে নজরদারি করা হয়।

স্কুলজীবনের প্রথম তিন বছর মেধা যাচাইয়ের জন্য নয়; বরং ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো হয়। জাপানিরা নম্রতা, ভদ্রতা বা নীতি-নৈতিকতায় পৃথিবী খ্যাত। শুধু বয়সে বড় হওয়া নয়, বরং মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রে যেন প্রতিফলিত হয় এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; এ সময় শুধু এ প্রয়াসই চালানো হয়। জাপানে শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে। গুরুজনদের সম্মান করা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া, সবাই মিলে কাজ করা ইত্যাদি শিক্ষা একদম ছেলেবেলায় জাপানিদের মনে গেঁথে দেয়া হয়।

উৎপল স্যার তার কলেজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায় সব ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তা, শিষ্টাচারিতা, নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষা নিশ্চিত করাই ছিল তার শিক্ষকতার পাশাপাশি অতিরিক্ত আরেকটি কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা ছিল অনেক আনন্দিত ও খুশি। শিক্ষার্থীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুঙ্গে। কলেজ প্রশাসনের লোকেরাও তাকে খুব ভালো বাসতেন এবং কলেজের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তারা তার ওপরে ভরসা রাখতে পারতেন বলে বিভিন্ন তথ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এমন একজন শিক্ষককে প্রাণ দিতে হলো তারই কলেজের একজন শিক্ষার্থীর হাতে! নৈতিক অবক্ষয়ের সীমা কতটুকু ছাড়ালে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে পারে এবং এমন বর্বরোচিত আচরণ করতে পারে, আমি একজন শিক্ষক হিসেবে ভীষন লজ্জিত ও বাকরুদ্ধ। এর ধিক্কার জানাই তীব্রভাবে।

সময়ের এ চরম ক্ষণে, আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শৃঙ্খলা এবং তাদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে। আমরা সবাই জানি, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনমুখী শিক্ষা অর্জিত হয় তার পরিবার থেকে। পারিবারিক শিক্ষায় যদি গলদ থেকে থাকে তার খেসারত দিতে হয় শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের। সুতরাং সন্তানের শৈশব কাল থেকেই প্যারেন্টিং হতে হবে কর্তৃত্বপূর্ণ ও জবাবদিহিতামূলোক। পরিবার থেকে যদি একটি শিশু আচার-আচরণ, নম্রতা-ভদ্রতা, শৃঙ্খলা-শিষ্টাচারিতা, আদব-কায়দা, আত্মসম্মানবোধ, নিঃস্বার্থপরতা ইত্যাদি একটি উত্তম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে, সে শিশু তার স্কুলে এসে সেগুলোই চর্চা করতে থাকবে এবং শিক্ষকরাও তাকে উন্নত শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে সক্ষম হবে।

শিক্ষক হচ্ছেন, মানুষ গড়ার সুনিপুণ কারিগর। শিশুরা স্কুলে ভর্তি হলে শিক্ষকরা তাদের আদর ও সোহাগ মাখা হৃদয় দিয়ে জ্ঞানের যে প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন তাতে তাদের প্রত্যেকেই হয়ে ওঠে পরিবার ও সমাজের সমহিমায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি শিক্ষক, তিনি শুধু বইভিত্তিক জ্ঞানেরই গুরু নন, তিনি হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া এক মহানায়ক। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক জীবনের আলোর দিশা দিয়ে থাকেন একজন শিক্ষক। পারিবারিক শিক্ষার সুসংস্কৃতি যখন স্কুল জীবনে প্রতিফলিত হয় তখন শিক্ষক সেগুলোকে দারুণভাবে প্রতিপালন করে তাদের বাস্তব জীবনে ক্রিয়াশীল করতে পারেন। ফলে, তাদের মধ্যে জেগে ওঠে ভদ্রতা, শিষ্টাচারিতা, শৃঙ্খলা, একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ, বাবা-মা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি সকল প্রকার মানবীয় গুণাবলি। আর এগুলোর সবই হলো নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ, যার অবক্ষয়ে সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা ও বর্বরচিত নানা অঘটন।

সুতরাং আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে, কীভাবে পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাত্যহিক শিক্ষা কর্মসূচিতে নীতি শিক্ষা ও নৈতিক চর্চার এমন কিছু পাঠাভ্যাস তৈরি করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে সুশৃঙ্খলাপূর্ণ, আদর্শ ও মহান চরিত্র মাধুর্যে অনুপম। আমার বিশ্বাস অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থাপক ও শিক্ষা প্রশাসক যদি একমত ও এক পথে নৈতিক অবক্ষয় রোধে কাজ করে, তাহলে শিক্ষাঙ্গনে আর এহেন পৈশাচিক ও নৃশংস কর্ম সম্পাদিত হবে না, বরং শিক্ষাঙ্গনগুলো হয়ে উঠবে শান্তিশৃঙ্খলা ও আদর্শের এক মূর্তপ্রতীক। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করতে চাই।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

শিক্ষক হত্যা : নৈতিক অবক্ষয়ের কদর্য রূপ

মাহমুদুল হাছান

শুক্রবার, ০১ জুলাই ২০২২

আমরা হতবাক, আমরা স্তম্ভিত, লজ্জায় আমরা হতবিহ্বল! শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে নিজ হাতে খুন করেছে! শিক্ষকেরা জাতির বিবেক ও মানুষ গড়ার কারিগর। উৎপল কুমার স্যার কি করেছিলেন কথিত শিক্ষার্থীর সঙ্গে, শাসন করেছিলেন, অশালীন কাজ থেকে বিরিত রাখতে চেয়েছিলেন, তাই তো? যে কাজ বাবা-মা করার কথা সেটি তিনিই করেছিলেন, এটিই কি তার অপরাধ? অথচ একজন শিক্ষক, শিক্ষার্থীর আধ্যাত্মিক পিতা-মাতা, যিনি শিক্ষার্থীদের আদর-স্নেহ করেন, আবার শাসন করেন আদর্শ মানুষ বানাতে। কিন্তু আফসোস! শিক্ষকদের হত্যা আর অপমানের মাধ্যমে এ আদর্শেরই হত্যা হলো।

এ দেশে শিক্ষক হত্যার ঘটনা এর আগে যে ঘটেনি, তা নয়। তাছাড়া, শিক্ষকদের অপমান, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বঞ্চনা অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি তো হরহামেশাই হচ্ছে। ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার হাজি ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যার মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হলো শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নৈতিক অধঃপতনের জঘন্য চিত্র। এ ঘটনা নিছক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ব্যাপার নয়। একে দেখতে হবে সমাজব্যবস্থার প্রগতির বাধা হিসেবে। একে দেখতে হবে, সমাজকে পিছিয়ে টেনে নেয়ার লক্ষণ হিসেবে।

আমরা সম্ভবত আমাদের নৈতিক বিপর্যয়ের চরম সীমায় অবস্থান করছি; নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনা বা সামান্য স্বার্থের জন্য কত মানুষকে জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। অনৈতিক ভাবেই, আমরা নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছি।

দৈনন্দিন জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন বেড়েই চলছে; যার লাগাম না টানলে জাতিকে চরম মাশুল দিতে হতে পারে। এখনই এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাব।

যে দেশে দিনের আলোয় জনসম্মুক্ষে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষককে অপমান করছে, নৃশংসভাবে হত্যা করছে, যার বিচার করার ক্ষমতা কারোর নেই, সে দেশের মানুষের নৈতিকতা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে, তা আমরা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছি। সম্ভবত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থার গলদের কারণে আমাদের নৈতিকতার আজ এ বিপর্যয় ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। আমাদের দেশের পিতা-মাতারা সন্তানকে মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করে থাকেন; কিন্তু সে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠছে কিনা তার চেষ্টা আমরা কতটুকু করি?

আমরা শুধু সন্তানদের জিপিএ-৫ পাওয়ার পেছনে ছুটে বেড়াই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়, পাঠ্যসূচিতে অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত বিষয় খুব কমই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা সন্তানদের শিশু বয়স থেকেই বইয়ের ভারে নুইয়ে ফেলি, তারা মেধাবী হয় ঠিকই; কিন্তু একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠে না।

নৈতিকতা বিপর্যয়ের ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। এজন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার যথাযথ ব্যবস্থা ও প্রয়োগ। শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক শিক্ষার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বাস্তবায়ন কৌশল থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারি। জাপানিরা নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুশৃঙ্খল অমায়িক চরিত্রের অধিকারী একটি জাতি হিসেবে পরিচিত। জাপানের শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে নৈতিক শিক্ষা। তাদের বিশ্বাস, আগে নীতি-নৈতিকতা, পরে পাঠ্য শিক্ষা। জাপানে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত কোনো ধরনের পুঁথিগত বিষয়ে পরীক্ষা না নিয়ে শিশুদের শারীরিক, মানসিক এবং নৈতিক বিকাশের দিকেই বিশেষভাবে নজরদারি করা হয়।

স্কুলজীবনের প্রথম তিন বছর মেধা যাচাইয়ের জন্য নয়; বরং ভদ্রতা, নম্রতা, শিষ্টাচার, দেশপ্রেম ও ন্যায়পরায়ণতা শেখানো হয়। জাপানিরা নম্রতা, ভদ্রতা বা নীতি-নৈতিকতায় পৃথিবী খ্যাত। শুধু বয়সে বড় হওয়া নয়, বরং মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য তাদের চরিত্রে যেন প্রতিফলিত হয় এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; এ সময় শুধু এ প্রয়াসই চালানো হয়। জাপানে শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়ে থাকে। গুরুজনদের সম্মান করা, মানুষের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেয়া, সবাই মিলে কাজ করা ইত্যাদি শিক্ষা একদম ছেলেবেলায় জাপানিদের মনে গেঁথে দেয়া হয়।

উৎপল স্যার তার কলেজে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকায় সব ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তা, শিষ্টাচারিতা, নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষা নিশ্চিত করাই ছিল তার শিক্ষকতার পাশাপাশি অতিরিক্ত আরেকটি কাজ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার শিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা ছিল অনেক আনন্দিত ও খুশি। শিক্ষার্থীদের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল তুঙ্গে। কলেজ প্রশাসনের লোকেরাও তাকে খুব ভালো বাসতেন এবং কলেজের শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তারা তার ওপরে ভরসা রাখতে পারতেন বলে বিভিন্ন তথ্যে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! এমন একজন শিক্ষককে প্রাণ দিতে হলো তারই কলেজের একজন শিক্ষার্থীর হাতে! নৈতিক অবক্ষয়ের সীমা কতটুকু ছাড়ালে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে পারে এবং এমন বর্বরোচিত আচরণ করতে পারে, আমি একজন শিক্ষক হিসেবে ভীষন লজ্জিত ও বাকরুদ্ধ। এর ধিক্কার জানাই তীব্রভাবে।

সময়ের এ চরম ক্ষণে, আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শৃঙ্খলা এবং তাদের পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে। আমরা সবাই জানি, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনমুখী শিক্ষা অর্জিত হয় তার পরিবার থেকে। পারিবারিক শিক্ষায় যদি গলদ থেকে থাকে তার খেসারত দিতে হয় শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের। সুতরাং সন্তানের শৈশব কাল থেকেই প্যারেন্টিং হতে হবে কর্তৃত্বপূর্ণ ও জবাবদিহিতামূলোক। পরিবার থেকে যদি একটি শিশু আচার-আচরণ, নম্রতা-ভদ্রতা, শৃঙ্খলা-শিষ্টাচারিতা, আদব-কায়দা, আত্মসম্মানবোধ, নিঃস্বার্থপরতা ইত্যাদি একটি উত্তম প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে, সে শিশু তার স্কুলে এসে সেগুলোই চর্চা করতে থাকবে এবং শিক্ষকরাও তাকে উন্নত শিক্ষা দিয়ে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে সক্ষম হবে।

শিক্ষক হচ্ছেন, মানুষ গড়ার সুনিপুণ কারিগর। শিশুরা স্কুলে ভর্তি হলে শিক্ষকরা তাদের আদর ও সোহাগ মাখা হৃদয় দিয়ে জ্ঞানের যে প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন তাতে তাদের প্রত্যেকেই হয়ে ওঠে পরিবার ও সমাজের সমহিমায় উদ্ভাসিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যিনি শিক্ষক, তিনি শুধু বইভিত্তিক জ্ঞানেরই গুরু নন, তিনি হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়া এক মহানায়ক। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক জীবনের আলোর দিশা দিয়ে থাকেন একজন শিক্ষক। পারিবারিক শিক্ষার সুসংস্কৃতি যখন স্কুল জীবনে প্রতিফলিত হয় তখন শিক্ষক সেগুলোকে দারুণভাবে প্রতিপালন করে তাদের বাস্তব জীবনে ক্রিয়াশীল করতে পারেন। ফলে, তাদের মধ্যে জেগে ওঠে ভদ্রতা, শিষ্টাচারিতা, শৃঙ্খলা, একে অন্যের প্রতি সম্মানবোধ, বাবা-মা ও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইত্যাদি সকল প্রকার মানবীয় গুণাবলি। আর এগুলোর সবই হলো নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ, যার অবক্ষয়ে সৃষ্টি হয় ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে চরম বিশৃঙ্খলা ও বর্বরচিত নানা অঘটন।

সুতরাং আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে, কীভাবে পরিবার ও শিক্ষাঙ্গনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাত্যহিক শিক্ষা কর্মসূচিতে নীতি শিক্ষা ও নৈতিক চর্চার এমন কিছু পাঠাভ্যাস তৈরি করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা হয়ে ওঠে সুশৃঙ্খলাপূর্ণ, আদর্শ ও মহান চরিত্র মাধুর্যে অনুপম। আমার বিশ্বাস অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থাপক ও শিক্ষা প্রশাসক যদি একমত ও এক পথে নৈতিক অবক্ষয় রোধে কাজ করে, তাহলে শিক্ষাঙ্গনে আর এহেন পৈশাচিক ও নৃশংস কর্ম সম্পাদিত হবে না, বরং শিক্ষাঙ্গনগুলো হয়ে উঠবে শান্তিশৃঙ্খলা ও আদর্শের এক মূর্তপ্রতীক। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করতে চাই।

[লেখক : প্রিন্সিপাল, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকা]

back to top