alt

উপ-সম্পাদকীয়

সত্য কাজে কেউ নয় রাজি

এম এ কবীর

: বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

শিক্ষকের চরিত্র ও নীতিবোধ যদি স্বচ্ছ না হয়, তাহলে সমাজে নীতি-নৈতিকতা থাকে না। শিক্ষকতা যখন অর্থ রোজগারের হাতিয়ার, তখন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা হয়ে পড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মতো। একজন শিক্ষক জ্ঞানের দোকানি এবং ক্রেতা ছাত্রছাত্রীরা টাকার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ভালো ফলাফলের সনদ কেনে। এখানে দরদাম ঠিক করে নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষা বেচাকেনা হয়। শিক্ষকদের অর্থলোভী মনোভাব শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের প্রতি ছাত্রছাত্রীর প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে কীভাবে? পুরো জাতিকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে আমরা কীভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সৎ এবং নীতিবান মানুষের খোঁজ করি? অনৈতিক শিক্ষার কারণে শিক্ষকদের ছাত্রের হাতে এখন প্রায়ই নিগৃহীত হতে শোনা যায়। সৎচরিত্রের গুণে এখন আর কোনো শিক্ষক সম্মানিত হতে চান না। অর্থনৈতিকভাবে ধনী হয়ে ফেক সম্মান কেনেন। যে শিক্ষক নিজেকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে চরিত্র কুলষিত করেছেন, নৈতিকতার শিক্ষা তার কাছে আশা করা মূর্খতা। যে শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই সেই শিক্ষকের শিক্ষা দিয়ে দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল আশা করা আর অর্বাচীনের সফল চন্দ্র অভিযান সমান কথা।

২০২২ সালের দিনাজপুর বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ছয় বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এবং চারটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যেসব বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে- সেগুলো হলো গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কেন্দ্র সচিব ও নেহাল উদ্দীন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ সত্য গোপন করে অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

যখন শিক্ষকজাতি বিবেকহীন, অর্থলোভী, জ্ঞানকূন্য হয়ে পড়ে- তখন সমাজ ও রাষ্ট্র অন্ধকারে ঢেকে যায়। কারণ একজন শিক্ষকই জ্ঞানের আলো জ্বেলে সমাজের কোণে কোণে লেপ্টে থাকা অন্ধকার তাড়াতে পারেন। সেই শিক্ষক যখন নিজেই দুর্নীতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তখন কে এই অন্ধকার সমাজটাকে আলোকিত করবেন? মাত্র ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় হাতে লেখা একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরিক্ষা আগেই সমাপ্ত হওয়ায় এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে বলে জানানো হয়।

এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলেই পরিক্ষা বাতিল করা হবে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন। প্রয়োজনে একই পরীক্ষা ১০ বার নিয়ে ফল প্রকাশের কথাও বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের পর পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক? অর্থের মোহে একদল মানুষ প্রশ্ন পত্র ফাঁস করছে, এর বিপরীতে লাখো শিক্ষার্থীর পরিক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে আমরা কি শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করতে পারি? তবে কেন পরীক্ষা বাতিল করে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে? শাস্তি যদি দিতে হয়, তবে দোষীদের দিতে হবে। দোষীদের শাস্তির আওতায় না এনে পরীক্ষা বাতিল করা রীতিমতো অন্যায়। প্রশ্ন ফাঁস রোধের ব্যর্থতা কার? ব্যর্থতা যারই হোক দায়ভার সবার। বর্তমানে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কয়টা পরীক্ষা বাতিল করা সম্ভব? এ পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসকারী অনেকেই ধরা পড়েছে। পত্রিকা, টেলিভিশনে তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখানো হয় না। পরবর্তী সময়ে তাদের কী শাস্তি হলো, সেটা জানা যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এ শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এমনকি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই শাস্তির এ বিধান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। প্রশ্ন ফাঁসের পর তদন্ত কমিটি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি হয় না।

দুর্নীতিবিরোধী একাধিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে সুনাম কুড়ানো চীনের সাবেক বিচারবিষয়ক মন্ত্রীকে ঘুষ নেয়ার দায়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারাদন্ড প্রাপ্ত ফু ঝেংঝু উপহার হিসেবে ও অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ১১ কোটি ৭০ লাখ ইউয়ান (চীনা মুদ্রা) ঘুষ নেন। জুলাইয়ে এসব অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। জিলিন প্রদেশের রাজধানী চ্যাংচুনের একটি আদালত তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। ফুয়ের কারাদন্ডের রায়ের আগে চলতি সপ্তাহেই চীনের তিন প্রদেশের সাবেক তিনজন পুলিশ প্রধানকে কারাদন্ড দেয়া হয়।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালা (শৃঙ্খলা ও আপিল) ২(খ) ও (অ)-এর বিধি মতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আরো দুই শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ককে আটক করে থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- ওই বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম ও অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এ নিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাড়ালো ছয় জনে।

শিক্ষা কি? কেন এবং কীভাবে এটি প্রদান করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হয় এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায়- এমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও এখনো অনেক দেশেই শিক্ষার সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়- এজন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন এর বিষয়েও উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সব ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত, মার্জিত করে তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া দরকার।

১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেয়া হয়েছিল যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব-নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে শিক্ষায় অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দলীয়করণের ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার প্রার্থী অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নকাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের। সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ রেজাল্ট পাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষাব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারার ঘটনা আদালতে গড়িয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো, যার টাকা আছে সেই সেটা কিনতে পারছে।

ফকির লালন বহুদিন আগেই বলেছেন- সত্য কাজে কেউ নয় রাজি। আমাদের ৪১ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের কোয়ালিটি সঠিক আছে কিনা? আমরা এখন কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক করছি। কিন্তু বাঁশি যে বাজাবে, তাকে বাঁশি বাজানো শেখাচ্ছি না। তাকে শেখাচ্ছি বাঁশি লম্বা কতটুকু, বাঁশির ছিদ্র কয়টা, বাঁশি দেখতে কেমন। বাঁশি বাজানো প্র্যাকটিস ছাড়া কেউ শিখতে পারে না।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

সত্য কাজে কেউ নয় রাজি

এম এ কবীর

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

শিক্ষকের চরিত্র ও নীতিবোধ যদি স্বচ্ছ না হয়, তাহলে সমাজে নীতি-নৈতিকতা থাকে না। শিক্ষকতা যখন অর্থ রোজগারের হাতিয়ার, তখন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটা হয়ে পড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার মতো। একজন শিক্ষক জ্ঞানের দোকানি এবং ক্রেতা ছাত্রছাত্রীরা টাকার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ভালো ফলাফলের সনদ কেনে। এখানে দরদাম ঠিক করে নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষা বেচাকেনা হয়। শিক্ষকদের অর্থলোভী মনোভাব শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের প্রতি ছাত্রছাত্রীর প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেবে কীভাবে? পুরো জাতিকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে আমরা কীভাবে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সৎ এবং নীতিবান মানুষের খোঁজ করি? অনৈতিক শিক্ষার কারণে শিক্ষকদের ছাত্রের হাতে এখন প্রায়ই নিগৃহীত হতে শোনা যায়। সৎচরিত্রের গুণে এখন আর কোনো শিক্ষক সম্মানিত হতে চান না। অর্থনৈতিকভাবে ধনী হয়ে ফেক সম্মান কেনেন। যে শিক্ষক নিজেকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে চরিত্র কুলষিত করেছেন, নৈতিকতার শিক্ষা তার কাছে আশা করা মূর্খতা। যে শিক্ষকের নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই সেই শিক্ষকের শিক্ষা দিয়ে দেশ ও জাতির কোনো মঙ্গল আশা করা আর অর্বাচীনের সফল চন্দ্র অভিযান সমান কথা।

২০২২ সালের দিনাজপুর বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ছয় বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এবং চারটি বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যেসব বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে- সেগুলো হলো গণিত, কৃষি বিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কেন্দ্র সচিব ও নেহাল উদ্দীন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর চার বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ সত্য গোপন করে অনিবার্য কারণে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

যখন শিক্ষকজাতি বিবেকহীন, অর্থলোভী, জ্ঞানকূন্য হয়ে পড়ে- তখন সমাজ ও রাষ্ট্র অন্ধকারে ঢেকে যায়। কারণ একজন শিক্ষকই জ্ঞানের আলো জ্বেলে সমাজের কোণে কোণে লেপ্টে থাকা অন্ধকার তাড়াতে পারেন। সেই শিক্ষক যখন নিজেই দুর্নীতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তখন কে এই অন্ধকার সমাজটাকে আলোকিত করবেন? মাত্র ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় হাতে লেখা একটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরিক্ষা আগেই সমাপ্ত হওয়ায় এ ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে বলে জানানো হয়।

এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরিক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলেই পরিক্ষা বাতিল করা হবে বলে জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন। প্রয়োজনে একই পরীক্ষা ১০ বার নিয়ে ফল প্রকাশের কথাও বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের পর পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক? অর্থের মোহে একদল মানুষ প্রশ্ন পত্র ফাঁস করছে, এর বিপরীতে লাখো শিক্ষার্থীর পরিক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে আমরা কি শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করতে পারি? তবে কেন পরীক্ষা বাতিল করে তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে? শাস্তি যদি দিতে হয়, তবে দোষীদের দিতে হবে। দোষীদের শাস্তির আওতায় না এনে পরীক্ষা বাতিল করা রীতিমতো অন্যায়। প্রশ্ন ফাঁস রোধের ব্যর্থতা কার? ব্যর্থতা যারই হোক দায়ভার সবার। বর্তমানে প্রায় সব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। কয়টা পরীক্ষা বাতিল করা সম্ভব? এ পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসকারী অনেকেই ধরা পড়েছে। পত্রিকা, টেলিভিশনে তাদের চেহারা স্পষ্ট দেখানো হয় না। পরবর্তী সময়ে তাদের কী শাস্তি হলো, সেটা জানা যায় না। প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর ৪ নম্বর ধারায় এ শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, এমনকি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই শাস্তির এ বিধান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। প্রশ্ন ফাঁসের পর তদন্ত কমিটি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি হয় না।

দুর্নীতিবিরোধী একাধিক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে সুনাম কুড়ানো চীনের সাবেক বিচারবিষয়ক মন্ত্রীকে ঘুষ নেয়ার দায়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারাদন্ড প্রাপ্ত ফু ঝেংঝু উপহার হিসেবে ও অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ১১ কোটি ৭০ লাখ ইউয়ান (চীনা মুদ্রা) ঘুষ নেন। জুলাইয়ে এসব অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। জিলিন প্রদেশের রাজধানী চ্যাংচুনের একটি আদালত তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। ফুয়ের কারাদন্ডের রায়ের আগে চলতি সপ্তাহেই চীনের তিন প্রদেশের সাবেক তিনজন পুলিশ প্রধানকে কারাদন্ড দেয়া হয়।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে- দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালা (শৃঙ্খলা ও আপিল) ২(খ) ও (অ)-এর বিধি মতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।

এদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আরো দুই শিক্ষক এবং একজন অফিস সহায়ককে আটক করে থানা পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- ওই বিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন, পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম ও অফিস সহায়ক সুজন মিয়া। এ নিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাড়ালো ছয় জনে।

শিক্ষা কি? কেন এবং কীভাবে এটি প্রদান করা যায় সে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ভোগবাদী সমাজে মুনাফাভিত্তিক এবং পুঁজিবাদী সমাজে যেভাবে সব কিছুকে পণ্য ভাবা হয় এবং টাকা দিলে পণ্যের মতো সবই পাওয়া যায়- এমন প্রবণতা সৃষ্টির চেষ্টা চললেও এখনো অনেক দেশেই শিক্ষার সাংবিধানিক এবং মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি আছে। সেই বিবেচনায় শিক্ষার দর্শন নির্ধারিত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য হওয়ার কথা নয়- এজন্য ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়ন এর বিষয়েও উন্নতি হওয়া দরকার। ব্যক্তির দেহ ও মনের সব ক্ষমতা বিকশিত, বিবর্তিত, মার্জিত করে তাকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান নৈপুণ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলার ব্যবস্থাদির নাম যদি শিক্ষা হয়, তাহলে মানবতাবাদী এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে শিক্ষার দর্শন, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া দরকার।

১৮৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে লর্ড মেকলেকে দিয়ে সেই শিক্ষানীতি দেয়া হয়েছিল যা অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন ও হিসাব-নিকাশ করার মতো একটি জাতি সৃষ্টি ছাড়া সৃজনশীল ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী বা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো চেতনাবোধ ওই শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়নি। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতি এবং সংবিধানের ১৭ এর খ ধারার আলোকে জাতীয় বাজেটে জিডিপির প্রাথমিকভাবে ৫ শতাংশ এবং পর্যায়ক্রমে ইউনেস্কোকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে শিক্ষায় অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাড়েনি, শিক্ষা প্রশাসনে দলীয়করণের ভূত, বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডিতে দলীয়করণ এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দলীয়করণের ফলে দলীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলায় তুলনামূলক কম যোগ্যতার প্রার্থী অগ্রাধিকার পাচ্ছে, ফলে শিক্ষার গুণগতমানের ক্ষেত্রে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নকাজের টাকার কমিশন বণ্টনে সমঝোতা করতে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালীদের। সৃজনশীল আর এমসিকিউ পরীক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে এ+ রেজাল্ট পাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক মানের দিক থেকে অনেক নিচে অবস্থান করছে। বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা শিক্ষাব্যবসা শুরু করে শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিদের মধ্যে টাকা ভাগবাটোয়ারার ঘটনা আদালতে গড়িয়েছে। মৌলিক অধিকার শিক্ষা আজ সুপার মার্কেটের পণ্যের মতো, যার টাকা আছে সেই সেটা কিনতে পারছে।

ফকির লালন বহুদিন আগেই বলেছেন- সত্য কাজে কেউ নয় রাজি। আমাদের ৪১ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের কোয়ালিটি সঠিক আছে কিনা? আমরা এখন কোয়ালিটি ফ্রেমওয়ার্ক করছি। কিন্তু বাঁশি যে বাজাবে, তাকে বাঁশি বাজানো শেখাচ্ছি না। তাকে শেখাচ্ছি বাঁশি লম্বা কতটুকু, বাঁশির ছিদ্র কয়টা, বাঁশি দেখতে কেমন। বাঁশি বাজানো প্র্যাকটিস ছাড়া কেউ শিখতে পারে না।

[লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক; সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি]

back to top