alt

উপ-সম্পাদকীয়

বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার হোক স্বতন্ত্র পরিচয়

বিভূতী ভূষণ মাহাতো, উত্তম কুমার মাহাতো, রামপ্রসাদ মাহাতো, প্রভাষবন্ধু মাহাতো, সান্ত¡না মাহাতো, ববিতা মাহাতো, পলাশ কুমার মাহাতো, পরিতোষ মাহাতো, শিউলি মাহাতো

: সোমবার, ০৩ অক্টোবর ২০২২

“মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত একটি আদিবাসী জাতিসত্তা। ২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৫০টি জাতিসত্তাকে গেজেটে অন্তর্ভুক্তির সংশোধনী তালিকা প্রকাশ করে। বেদিয়া ও কুর্মি দুই জাতিসত্তাকে একীভূত করে “মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” হিসেবে গেজেটভুক্ত করায় বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয়ের সংকট ও বিভ্রান্তিতে পড়েছে। কারণ, মাহাতো জাতিসত্তা নয়; মাহাতো হলো পদবি।

‘মাহাতো’ পদবি মূলত বাংলাদেশে বসবাসরত “বেদিয়া” ও “কুর্মি” জাতিসত্তার মানুষ ব্যবহার করেন। মাহাতো পদবি ব্যবহার করায় বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তাকে গেজেটে “মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। দুই জাতিসত্তাকে একত্রে গেজেটভুক্ত করার ফলে বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ তাদের জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে। এদিকে, সিলেট অঞ্চলের বসবাসরত কুর্মিরা পদবি হিসেবে কুর্মি ব্যবহার করেন এবং কুর্মি জাতিসত্তা হিসেবেই পরিচয় দেন। কুর্মিরা গ্রামপ্রধানকে মাহাতো বলে। কুর্মিরা নিজেদের কুর্মি জাতির পরিচয় দিলেও বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কুর্মি আত্মপরিচয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

‘মাহাতো’ পদবি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবহার করে আসছে। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হার্বার্ট হোপ রিজলি’র “দ্যা ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল” (The Tribes and Castes of Bengal) এথনোগ্রাফিক গবেষণায় দেখিয়েছেন- বেদিয়া, কুর্মি, মুসহর, নুনিয়া, খেড়ওয়ার, মুন্ডা, ওরাও, রাজোয়ার, চিক, পাতর, থারু, বিন্দ, ধোবি, কৈরী, তাঁতি, দুসাত, কাহার, পাসি, গোয়ালা, কুমহার, ধানুক প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও তফশিলী সম্প্রদায়ের মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করে থাকে।

রিজলি তার এথনোগ্রাফিক গবেষণায় আরও উল্লেখ করেন, মুন্ডা সমাজ কাঠামোয় ‘মাহাতো’ নামে দাপ্তরিক পদবি রয়েছে। মাহাতো সেখানে গ্রাম্য হিসাবরক্ষক বা গ্রাম্য সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করত (পৃ. ১০৫)। তিনি ‘ড. ডেভিডসনস রিপোর্ট-১৮৩৯’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে মাহাতোর কার্যক্রম তুলে ধরে দেখান যে মাহাতো গ্রামের বিভিন্ন রায়তের চাষাবাদের হিসাব সংক্রান্ত যেমন- কৃষককে জমি চাষ করতে দেয়া, কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, রায়তে নতুন জমি যুক্ত হওয়া ইত্যাদি কাজ করেন (পৃ. ১০৬)। মুন্ডা সমাজের মতই ওরাঁও সমাজ পরিচালনায় ‘মাহাতো’ নামে প্রশাসনিক অফিসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওরাঁওদের গ্রাম প্রধানকে মাহাতো নামে ডাকা হয়। এডওয়ার্ড টুইট ডালটনও তাঁর “ডেসক্রিপটিভ অ্যাথনোলজি অব বেঙ্গল” (১৮৭২) গ্রন্থে মাহাতো সম্পর্কে একই কথা তুলে ধরেছেন। কড়া জাতিসত্তার মানুষ তাদের গ্রামপ্রধানকে ‘মাহাতো’ বলে (সালেক খোকন : ২০১৪)।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ গোত্রভিত্তিক। প্রতিটি আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব গোত্র প্রথা রয়েছে এবং তা মেনে চলে

১৮৭২ সালের “রিপোর্ট অন দ্যা সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৭২” এ ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বৃহত্তর বাংলার অন্তর্ভুক্ত পাঁচ প্রদেশের (বাংলা, ছোটনাগপুর, ওড়িশ্যা, বিহার, ও আসাম) শুমারির রিপোর্টে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তালিকায় ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়ের নাম নেই। বৃহত্তর বাংলায় তৎকালীন ‘মাহাতো’ পদবি ব্যবহারকারী বেদিয়া, ভুমিজ, ভুইয়া, ওরাঁও, মুন্ডা, দুসাদ, খাড়োয়াড়, রাজোয়ার, চিক, পাসি, কুর্মি, কৈরি, নুনিয়া, কুমহার, ধোবি, গোয়ালা, তাঁতি প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তালিকা রয়েছে। ১৮৮১ সালেও ‘রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৮১’-এ মাহাতো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। ১৮৭২ সালের বেঙ্গল শুমারিতে ছোটনাগপুর প্রদেশে আদিবাসী খাড়োয়ার জাতিসত্তার চারটি উপগোত্রের মধ্যে একটি মাহাতো নামে পাওয়া গেলেও ১৮৮১ সালের বেঙ্গল শুমারিতে তার খোঁজ পাওয়া যায় না। ভারতের তফসিলি আদিবাসী, তফসিলি সম্প্রদায় ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের তালিকায় ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব নেই। তবে মাহাতো পদবি ব্যবহারকারী জাতিসত্তাগুলো নিজ জাতিসত্তার নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত রয়েছে।

বাংলাদেশের গবেষকগণ কখনো বেদিয়া, কখনো কুর্মি জাতিসত্তার তথ্য-উপাত্তকে মাহাতো জাতিসত্তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। কারণ, দুটি জাতিসত্তার মানুষ একই পদবি ‘মাহাতো’ ব্যবহার করেন। গবেষকগণ আবার কোন গবেষণায় বলেছেন ‘মাহাতো’ কয়েক প্রকারের যেমন- বেদিয়া মাহাতো, কুর্মি মাহাতো, ভুইয়া মাহাতো, শিকড়িয়া মাহাতো, পউরিয়া মাহাতো ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, বেদিয়া জাতিসত্তার মানুষ ‘মাহাতো’ পদবি ব্যবহার করায় বলা হয় বেদিয়া মাহাতো এবং কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করায় বলা হয় কুর্মি মাহাতো। এ ছাড়া ভুইয়া মাহাতো ভুইয়া (মুসহর) জাতিসত্তার অংশ, শিকড়িয়া মাহাতো রাজোয়াড় জাতিসত্তার অংশ, পউরিয়া মাহাতো হলো কৈরী সম্প্রদায়ের অংশ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করেন।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ গোত্রভিত্তিক। প্রতিটি আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব গোত্র প্রথা রয়েছে এবং তা মেনে চলে। প্রফেসর মেসবাহ কামাল সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসী’ (২০১০) শীর্ষক এথনোগ্রাফিয় গবেষেণা গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে ‘মাহাতো’ নামে জাতিসত্তার বর্ণনা দিলেও সেখানে অধিকাংশই বেদিয়া জাতিসত্তার ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি তুলে ধরেছেন এবং কুর্মিদের তথ্যের সঙ্গেও সংমিশ্রণ করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বেদিয়া মাহাতোদের সঙ্গে কুর্মি মাহাতোর বিয়ের প্রচলন নেই। এটা সত্য। মাহাতো হিসেবে যে গোত্র বা টোটেমের উল্লেখ করা হয়েছে তা বেদিয়া জাতিসত্তার গোত্র বা টোটেম প্রথা। সেখানে কুর্মিদের গোত্রের কথা তুলে ধরা হয়নি। বেদিয়াদের গোত্র ও কুর্মিদের গোত্র আলাদা। আবার মাহাতোদের ভাষা কুড়মালি বলা হয়েছে তা ঠিক নয়। কুড়মালি হলো কুর্মি জাতির ভাষা।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগ, উত্তর-পূর্বঞ্চালের সিলেট বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ‘মাহাতো’ পদবি ব্যহারকারী বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ বাস করেন। বেদিয়া, কুর্মি দুই জাতিসত্তার মানুষ একই পদবি ব্যবহার করায় তাদের বিভিন্ন গবেষণা ও রাষ্ট্রের তালিকায় মাহাতো নামেই উপস্থাপন ও পরিচিতি করানো হচ্ছে। বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তা দুটি আলাদা জাতিসত্তা তাঁর প্রমাণ ১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের “রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল”, ১৮৯১ সালের রিজলির দ্য ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল” (The Tribes and Castes of Bengal) এথনোগ্রাফিক গবেষণা, এডওয়ার্ড টুইট ডাল্টনের “ডেসক্রিপ্টিভ এথনোলজি অব বেঙ্গল” (১৮৭২), উইলিয়াম উইলসন হান্টারের “অ্যা স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল” (১৮৭৫-১৮৭৭), সুবোধ ঘোষের “ভারতের আদিবাসী” (১৯৪৮) গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ বেদিয়া, কুর্মি, ওরাঁও, মুন্ডা, গঞ্জু, ভূমিজ, ঘাসিমালো, তুরি ইত্যাদির পদবি, ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতি-নীতিতে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। সাঁওতাল ও মাহালি জাতিসত্তার মানুষের পদবি ব্যবহারে মিল রয়েছে। ভুমিজ, গঞ্জু, তুরি ও ওরাঁও জাতিসত্তার মানুষ ‘সিং’ পদবি ব্যবহার করেন। পদবি একই হলেও জাতিসত্তাগুলোর স্বতন্ত্র বা আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে আত্মপরিচয় রয়েছে। কারণ, পদবি একই হলেই জাতিসত্তা এক হয়ে যায় না। অপর দিকে, মাহাতো পদবি ব্যবহারকারী স্বতন্ত্র দুটি জাতিসত্তাকে পদবির নামেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মাহাতো’ পদবিকে জাতিসত্তা হিসেবে উপস্থাপন ও পরিচিতি করার মাধ্যমে বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়কে মুছে ফেলা হচ্ছে।

বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করতে আদিবাসী জাতিসত্তার তালিকায় (গেজেট) সংশোধন করা জরুরি। মাহাতো কোনো জাতিসত্তা নয়। মাহাতো বাদ দিয়ে কুর্মি ও বেদিয়া জাতিসত্তাকে আলাদা করে তালিকাভুক্ত করা দরকার। রাষ্ট্রীয় গেজেটে মাহাতো নয়, বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার নামেই দুটি জাতিসত্তার নিজস্ব আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দেয়া হোক।

[লেখকবৃন্দ বাংলাদেশে বসবাসরত বেদিয়া জাতিসত্তার সদস্য]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার হোক স্বতন্ত্র পরিচয়

বিভূতী ভূষণ মাহাতো, উত্তম কুমার মাহাতো, রামপ্রসাদ মাহাতো, প্রভাষবন্ধু মাহাতো, সান্ত¡না মাহাতো, ববিতা মাহাতো, পলাশ কুমার মাহাতো, পরিতোষ মাহাতো, শিউলি মাহাতো

সোমবার, ০৩ অক্টোবর ২০২২

“মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” বাংলাদেশ সরকারের গেজেটভুক্ত একটি আদিবাসী জাতিসত্তা। ২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ৫০টি জাতিসত্তাকে গেজেটে অন্তর্ভুক্তির সংশোধনী তালিকা প্রকাশ করে। বেদিয়া ও কুর্মি দুই জাতিসত্তাকে একীভূত করে “মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” হিসেবে গেজেটভুক্ত করায় বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয়ের সংকট ও বিভ্রান্তিতে পড়েছে। কারণ, মাহাতো জাতিসত্তা নয়; মাহাতো হলো পদবি।

‘মাহাতো’ পদবি মূলত বাংলাদেশে বসবাসরত “বেদিয়া” ও “কুর্মি” জাতিসত্তার মানুষ ব্যবহার করেন। মাহাতো পদবি ব্যবহার করায় বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তাকে গেজেটে “মাহাতো/কুর্মি মাহাতো/বেদিয়া মাহাতো” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। দুই জাতিসত্তাকে একত্রে গেজেটভুক্ত করার ফলে বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ তাদের জাতিসত্তার প্রকৃত আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে। এদিকে, সিলেট অঞ্চলের বসবাসরত কুর্মিরা পদবি হিসেবে কুর্মি ব্যবহার করেন এবং কুর্মি জাতিসত্তা হিসেবেই পরিচয় দেন। কুর্মিরা গ্রামপ্রধানকে মাহাতো বলে। কুর্মিরা নিজেদের কুর্মি জাতির পরিচয় দিলেও বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে কুর্মি আত্মপরিচয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

‘মাহাতো’ পদবি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবহার করে আসছে। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হার্বার্ট হোপ রিজলি’র “দ্যা ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল” (The Tribes and Castes of Bengal) এথনোগ্রাফিক গবেষণায় দেখিয়েছেন- বেদিয়া, কুর্মি, মুসহর, নুনিয়া, খেড়ওয়ার, মুন্ডা, ওরাও, রাজোয়ার, চিক, পাতর, থারু, বিন্দ, ধোবি, কৈরী, তাঁতি, দুসাত, কাহার, পাসি, গোয়ালা, কুমহার, ধানুক প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও তফশিলী সম্প্রদায়ের মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করে থাকে।

রিজলি তার এথনোগ্রাফিক গবেষণায় আরও উল্লেখ করেন, মুন্ডা সমাজ কাঠামোয় ‘মাহাতো’ নামে দাপ্তরিক পদবি রয়েছে। মাহাতো সেখানে গ্রাম্য হিসাবরক্ষক বা গ্রাম্য সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করত (পৃ. ১০৫)। তিনি ‘ড. ডেভিডসনস রিপোর্ট-১৮৩৯’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে মাহাতোর কার্যক্রম তুলে ধরে দেখান যে মাহাতো গ্রামের বিভিন্ন রায়তের চাষাবাদের হিসাব সংক্রান্ত যেমন- কৃষককে জমি চাষ করতে দেয়া, কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা, রায়তে নতুন জমি যুক্ত হওয়া ইত্যাদি কাজ করেন (পৃ. ১০৬)। মুন্ডা সমাজের মতই ওরাঁও সমাজ পরিচালনায় ‘মাহাতো’ নামে প্রশাসনিক অফিসারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওরাঁওদের গ্রাম প্রধানকে মাহাতো নামে ডাকা হয়। এডওয়ার্ড টুইট ডালটনও তাঁর “ডেসক্রিপটিভ অ্যাথনোলজি অব বেঙ্গল” (১৮৭২) গ্রন্থে মাহাতো সম্পর্কে একই কথা তুলে ধরেছেন। কড়া জাতিসত্তার মানুষ তাদের গ্রামপ্রধানকে ‘মাহাতো’ বলে (সালেক খোকন : ২০১৪)।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ গোত্রভিত্তিক। প্রতিটি আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব গোত্র প্রথা রয়েছে এবং তা মেনে চলে

১৮৭২ সালের “রিপোর্ট অন দ্যা সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৭২” এ ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বৃহত্তর বাংলার অন্তর্ভুক্ত পাঁচ প্রদেশের (বাংলা, ছোটনাগপুর, ওড়িশ্যা, বিহার, ও আসাম) শুমারির রিপোর্টে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্তা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তালিকায় ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তা বা সম্প্রদায়ের নাম নেই। বৃহত্তর বাংলায় তৎকালীন ‘মাহাতো’ পদবি ব্যবহারকারী বেদিয়া, ভুমিজ, ভুইয়া, ওরাঁও, মুন্ডা, দুসাদ, খাড়োয়াড়, রাজোয়ার, চিক, পাসি, কুর্মি, কৈরি, নুনিয়া, কুমহার, ধোবি, গোয়ালা, তাঁতি প্রভৃতি আদিবাসী জাতিসত্তা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের তালিকা রয়েছে। ১৮৮১ সালেও ‘রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল ১৮৮১’-এ মাহাতো জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। ১৮৭২ সালের বেঙ্গল শুমারিতে ছোটনাগপুর প্রদেশে আদিবাসী খাড়োয়ার জাতিসত্তার চারটি উপগোত্রের মধ্যে একটি মাহাতো নামে পাওয়া গেলেও ১৮৮১ সালের বেঙ্গল শুমারিতে তার খোঁজ পাওয়া যায় না। ভারতের তফসিলি আদিবাসী, তফসিলি সম্প্রদায় ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের তালিকায় ‘মাহাতো’ নামে কোনো জাতিসত্তার অস্তিত্ব নেই। তবে মাহাতো পদবি ব্যবহারকারী জাতিসত্তাগুলো নিজ জাতিসত্তার নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত রয়েছে।

বাংলাদেশের গবেষকগণ কখনো বেদিয়া, কখনো কুর্মি জাতিসত্তার তথ্য-উপাত্তকে মাহাতো জাতিসত্তা হিসেবে তুলে ধরেছেন। কারণ, দুটি জাতিসত্তার মানুষ একই পদবি ‘মাহাতো’ ব্যবহার করেন। গবেষকগণ আবার কোন গবেষণায় বলেছেন ‘মাহাতো’ কয়েক প্রকারের যেমন- বেদিয়া মাহাতো, কুর্মি মাহাতো, ভুইয়া মাহাতো, শিকড়িয়া মাহাতো, পউরিয়া মাহাতো ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে, বেদিয়া জাতিসত্তার মানুষ ‘মাহাতো’ পদবি ব্যবহার করায় বলা হয় বেদিয়া মাহাতো এবং কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করায় বলা হয় কুর্মি মাহাতো। এ ছাড়া ভুইয়া মাহাতো ভুইয়া (মুসহর) জাতিসত্তার অংশ, শিকড়িয়া মাহাতো রাজোয়াড় জাতিসত্তার অংশ, পউরিয়া মাহাতো হলো কৈরী সম্প্রদায়ের অংশ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ মাহাতো পদবি ব্যবহার করেন।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ গোত্রভিত্তিক। প্রতিটি আদিবাসী জাতিসত্তার নিজস্ব গোত্র প্রথা রয়েছে এবং তা মেনে চলে। প্রফেসর মেসবাহ কামাল সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসী’ (২০১০) শীর্ষক এথনোগ্রাফিয় গবেষেণা গ্রন্থের তৃতীয় খন্ডে ‘মাহাতো’ নামে জাতিসত্তার বর্ণনা দিলেও সেখানে অধিকাংশই বেদিয়া জাতিসত্তার ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি তুলে ধরেছেন এবং কুর্মিদের তথ্যের সঙ্গেও সংমিশ্রণ করেছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে বেদিয়া মাহাতোদের সঙ্গে কুর্মি মাহাতোর বিয়ের প্রচলন নেই। এটা সত্য। মাহাতো হিসেবে যে গোত্র বা টোটেমের উল্লেখ করা হয়েছে তা বেদিয়া জাতিসত্তার গোত্র বা টোটেম প্রথা। সেখানে কুর্মিদের গোত্রের কথা তুলে ধরা হয়নি। বেদিয়াদের গোত্র ও কুর্মিদের গোত্র আলাদা। আবার মাহাতোদের ভাষা কুড়মালি বলা হয়েছে তা ঠিক নয়। কুড়মালি হলো কুর্মি জাতির ভাষা।

বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগ, উত্তর-পূর্বঞ্চালের সিলেট বিভাগ এবং ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ‘মাহাতো’ পদবি ব্যহারকারী বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার মানুষ বাস করেন। বেদিয়া, কুর্মি দুই জাতিসত্তার মানুষ একই পদবি ব্যবহার করায় তাদের বিভিন্ন গবেষণা ও রাষ্ট্রের তালিকায় মাহাতো নামেই উপস্থাপন ও পরিচিতি করানো হচ্ছে। বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তা দুটি আলাদা জাতিসত্তা তাঁর প্রমাণ ১৮৭২ ও ১৮৮১ সালের “রিপোর্ট অন দ্য সেন্সাস অব বেঙ্গল”, ১৮৯১ সালের রিজলির দ্য ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল” (The Tribes and Castes of Bengal) এথনোগ্রাফিক গবেষণা, এডওয়ার্ড টুইট ডাল্টনের “ডেসক্রিপ্টিভ এথনোলজি অব বেঙ্গল” (১৮৭২), উইলিয়াম উইলসন হান্টারের “অ্যা স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল” (১৮৭৫-১৮৭৭), সুবোধ ঘোষের “ভারতের আদিবাসী” (১৯৪৮) গ্রন্থসমূহে পাওয়া যায়।

আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহ বেদিয়া, কুর্মি, ওরাঁও, মুন্ডা, গঞ্জু, ভূমিজ, ঘাসিমালো, তুরি ইত্যাদির পদবি, ধর্মীয় আচার, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতি-নীতিতে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। সাঁওতাল ও মাহালি জাতিসত্তার মানুষের পদবি ব্যবহারে মিল রয়েছে। ভুমিজ, গঞ্জু, তুরি ও ওরাঁও জাতিসত্তার মানুষ ‘সিং’ পদবি ব্যবহার করেন। পদবি একই হলেও জাতিসত্তাগুলোর স্বতন্ত্র বা আলাদা জাতিসত্তা হিসেবে আত্মপরিচয় রয়েছে। কারণ, পদবি একই হলেই জাতিসত্তা এক হয়ে যায় না। অপর দিকে, মাহাতো পদবি ব্যবহারকারী স্বতন্ত্র দুটি জাতিসত্তাকে পদবির নামেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মাহাতো’ পদবিকে জাতিসত্তা হিসেবে উপস্থাপন ও পরিচিতি করার মাধ্যমে বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়কে মুছে ফেলা হচ্ছে।

বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সংকট দূর করতে আদিবাসী জাতিসত্তার তালিকায় (গেজেট) সংশোধন করা জরুরি। মাহাতো কোনো জাতিসত্তা নয়। মাহাতো বাদ দিয়ে কুর্মি ও বেদিয়া জাতিসত্তাকে আলাদা করে তালিকাভুক্ত করা দরকার। রাষ্ট্রীয় গেজেটে মাহাতো নয়, বেদিয়া ও কুর্মি জাতিসত্তার নামেই দুটি জাতিসত্তার নিজস্ব আত্মপরিচয় ফিরিয়ে দেয়া হোক।

[লেখকবৃন্দ বাংলাদেশে বসবাসরত বেদিয়া জাতিসত্তার সদস্য]

back to top