alt

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুষের বেঁচে থাকার দায়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

: শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশগত সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে প্রকট। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাপল ক্রফসট’ নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ভৌগলিক অবস্থান, ঘন জনবসতি, জীবিকার জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা, পূর্বাঞ্চলের হাওর-বাঁওড়, উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। প্রাকৃতিক পরিবেশের হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। প্রচন্ড খরতাপে পুড়ে ছারখার দেশ, জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। খাল-বিল, নদীনালা শুকিয়ে গেছে, মরুময়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এল-নিনোর প্রভাবে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির উত্তাপ স্বাভাবিকের তুলনায় ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পানির স্বাভাবিক রূপের পরিবর্তন এনে দেয়। ফলে বাংলাদেশে কখনো খরায় মাঠঘাট, ক্ষেতের ফসল পুড়ে দেয়। কখনো বা অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি ভূখন্ডে ঢুকে কমিয়ে দেয় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিনষ্ট হয়ে যায় শ্যামল বৃক্ষরাজি, পশুপাখি। শুকিয়ে যায় হাওর, বিল, খাল। সমুদ্রের পানির আয়তন বৃদ্ধিতে পলি জমে সমুদ্রের তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতাও আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামীর বাংলাদেশে ব্যাপক অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে প্রবল বন্যা, মরুময়তা, ঘূর্ণিঝড়, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্র্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে।

জলবায়ুর এতোসব পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বছরে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে সম্প্রতি ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া এই পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে কৃষি জিডিপি এক-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ হতে পারে অভ্যন্তরীণভাবে জলবায়ু অভিবাসী। পরিবেশের অবক্ষয়, পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বনিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। এক আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উত্তাপ বাড়ার কারণে হিমবাহের গলন আরও বাড়ার সম্ভাবনা। হিমালয় অঞ্চলে তৈরি হবে অসংখ্য হিমবাহ লেক। এসব লেকে বিস্ফোরণ হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সেক্ষেত্রে জলবায়ুর চরমভাবাপন্ন বৈরি আচরণ এবং পরিবেশের অবনমন দেশে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে চ্যালেঞ্জস্বরূপ। জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসিসি) সম্প্রতি রিপোর্টে উল্লেখিত জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করেছে, মানুষের নানা কর্মকান্ডের পরিণতিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত বরফ গলছে। মেরু অঞ্চলের বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বণ নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। ফলে বিভিন্ন জীবজন্তুর আবাসস্থল বদলাচ্ছে। এই শতকের শেষভাগে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে তার পরিণতি কী হতে পারে ভয়াবহ। সর্বশেষ প্রাপ্ত ভীতিকর দিক হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্র এবং বরফে আচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলার ফলে প্রণিজগতের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বজুড়ে মানুষের দৈনন্দিন নানা কর্মকান্ডে পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই শুষে নেয় সাগর। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেওয়ার এই মাত্রা দ্বিগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে গলছে অ্যান্টারর্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ডের বরফও। সারা বিশ্বে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার হিমবাহ রয়েছে, যা পৃথিবীর সাত লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিদ্যমান। এ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৭ সেন্টিমিটার।

বিশেষ করে, আন্দিজ, মধ্য ইউরোপ ও উত্তর এশিয়ায় যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই সব বরফগলা পানি গিয়ে পড়বে সাগরে। তবে আইপিসির শেষ রিপোর্টে জানা যায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে যা আগের ধারণার চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার অধিক। আর তা হলে মারাত্মক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের এক ডজনের বেশি বড় বড় শহর।

পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, সাগরের উচ্চতা বাড়লে নিচু উপকূলীয় এলাকার ৭০ কোটি মানুষ বিপদে পড়বে। সাগরের তাপমাত্রা বাড়লে আবহাওয়াও দিন দিন বিরূপ আচরণ শুরু করবে। জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেড়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশকিছু এলাকায় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার, যা মোট জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক ৭ ভাগ; যা মোকাবিলায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে অর্থায়নের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি নেই স্থলভাগের খুব ভেতরে বসবাসরত মানুষগুলোর। বন্যায় ক্ষতির মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যেতে পারে। সাগরের ৯০ শতাংশ প্রবাল বিলীন হতে পারে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। মাছের শরীরে পারদের মাত্রা বেড়ে গেলে জলজ প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বাড়তি তাপ। সাগরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি নিশ্চিতকরণের জন্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমানোর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বর্তমান বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে মাত্র ০.৫৬ শতাংশ বাংলাদেশ অবদান রাখলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশর ক্ষতির পরিমান অবর্ণনীয়। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে অর্থ বরাদ্দে আজও তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি।

আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে আসেনি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। অথচ ২০১৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য বাধ্যতামূলক চুক্তিরও সিদ্ধান্ত ছিল। বিগত দিনে মেক্সিকোর কানকুন সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে পৌঁছানো, অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা এবং পরিরর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্য নির্ধারণে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমান শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়ে আনার কথা ছিল। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এক অঙ্গীকারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম থাকে সেই ব্যাপারে বিশ্বের সকল দেশ একাত্মতা ঘোষণা করে।

চুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে এনে কোপেনহেগেন ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’ গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এসব উদ্যোগ উষ্ণায়ণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। জলবায়ু কর্মসম্মেলনে ‘গ্লোবাল কমিশন অন এ্যাডাপটেশন’ (জিসিএ) বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যরে স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি কার্বন অনিঃসরণকারী দেশ হিসাবে স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, কার্বন নিঃসরণ কার্যকরভাবে বন্ধ বা হ্রাস করা সম্ভব না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বর্তমান শতাব্দীতে তীব্রতর হতে থাকবে। ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যেসব অঞ্চলে পর্যাপ্ত ক্ষতি হয়েছে সেখানে অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি হ্রাসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উন্নত বিশ্বের কাছে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রশ্নে বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় এবং বিকল্প জ্বালানির সন্ধানে সহায়তার লক্ষ্যে উন্নত বা তুলনামূলক ধনী দেশ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর অর্থ সহায়তা এবং এই অর্থের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির যে প্রস্তাব রয়েছে তা বাস্তবায়ন আবশ্যক।

অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বলে অভিমত বিশ্বব্যাংকের। গেল ৫০ বছরে দেশ ঘূর্ণিঝড়ে মুত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি বাড়তে থাকায় অভিযোজন প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। নিম্ন কার্বন উন্নয়ন গতিপথ বাংলাদেশের অভিঘাতসহিষ্ণু আগামীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশে জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদুষণ এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনতে পারে যা; ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ হলেও বিপুল জনসংখ্যা ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে দেশের উন্নয়ন পথধারা গতানুগতিকভাবে চলতে থাকলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখজনকভাবে বেড়ে যাবে। দেশের শিল্পগুলোকে অধিকতর টেকসই পথে রূপান্তর করা গেলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগরায়ণ, আয় প্রবৃদ্ধি এবং আয় বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমান জ্বালানি ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে জ্বালানি সংরক্ষণ, গতানুগতিক জ্বালানি চাহিদা হ্রাস, বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দক্ষতার উন্নয়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার জোরদার করা জরুরি।

বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধ নিশ্চিত করে সামষ্টিক উন্নয়নে সাহায্য-সহযোগিতা বিনিময়, উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ক্ষরাসহিষ্ণু কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক পদ্ধতিতে শস্য ও বীজ সংরক্ষণসহ কৃষিজমি রক্ষার্থে বনভূমি উজাড়, জলাধার ভরাট বন্ধ করা ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই। ব-দ্বীপ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য প্রকল্পিত দীর্ঘ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০, নীতি এবং অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ডেল্টা ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচ গ্রহণ পরিবেশের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

কপ-২৭ সম্মেলনের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন পড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে অন্তত ২ লাখ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে। দেশগুলোর মূল বাজেটের বাইরে এই অর্থ সহায়তা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রদান করতে হবে। মিসরে চলমান জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিবেদনে এই অর্থ কার্বন নিঃসরণ কমানো, স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি, জলবায়ৃ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে পরিবেশ ও ভূমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যয় করা হবে বলে জানা যায়।

জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের পাশাপাশি দেশের উদ্ভাবন ও দক্ষতাকে সফলতার সাথে এগিয়ে নিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অধিক সম্পৃক্ততা জরুরি হয়ে পড়েছে। চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে, যার সমাধান জনগণের কাছে বিশ্ব নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুগুলোকে বাঁচাতে না পারলে বিশ্বসভ্যতাই হুমকির মুখে পড়বে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুষের বেঁচে থাকার দায়

মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশগত সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে প্রকট। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাপল ক্রফসট’ নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ভৌগলিক অবস্থান, ঘন জনবসতি, জীবিকার জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীলতা এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা, পূর্বাঞ্চলের হাওর-বাঁওড়, উত্তরাঞ্চলের খরাপ্রবণ এলাকা বিশ্বের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। প্রাকৃতিক পরিবেশের হচ্ছে আমূল পরিবর্তন। প্রচন্ড খরতাপে পুড়ে ছারখার দেশ, জনজীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। খাল-বিল, নদীনালা শুকিয়ে গেছে, মরুময়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে এল-নিনোর প্রভাবে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির উত্তাপ স্বাভাবিকের তুলনায় ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পানির স্বাভাবিক রূপের পরিবর্তন এনে দেয়। ফলে বাংলাদেশে কখনো খরায় মাঠঘাট, ক্ষেতের ফসল পুড়ে দেয়। কখনো বা অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসের লবণাক্ত পানি ভূখন্ডে ঢুকে কমিয়ে দেয় ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিনষ্ট হয়ে যায় শ্যামল বৃক্ষরাজি, পশুপাখি। শুকিয়ে যায় হাওর, বিল, খাল। সমুদ্রের পানির আয়তন বৃদ্ধিতে পলি জমে সমুদ্রের তলদেশ ক্রমশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতাও আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামীর বাংলাদেশে ব্যাপক অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে প্রবল বন্যা, মরুময়তা, ঘূর্ণিঝড়, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্র্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে।

জলবায়ুর এতোসব পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ বছরে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে বলে সম্প্রতি ‘কান্ট্রি ক্লাইমেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। এছাড়া এই পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে কৃষি জিডিপি এক-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে। এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ হতে পারে অভ্যন্তরীণভাবে জলবায়ু অভিবাসী। পরিবেশের অবক্ষয়, পৃথিবীর উত্তাপ বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিশ্বনিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। এক আন্তর্জাতিক গবেষণার তথ্যমতে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। উত্তাপ বাড়ার কারণে হিমবাহের গলন আরও বাড়ার সম্ভাবনা। হিমালয় অঞ্চলে তৈরি হবে অসংখ্য হিমবাহ লেক। এসব লেকে বিস্ফোরণ হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বাংলাদেশ।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশ, সেক্ষেত্রে জলবায়ুর চরমভাবাপন্ন বৈরি আচরণ এবং পরিবেশের অবনমন দেশে টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনে চ্যালেঞ্জস্বরূপ। জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেলের (আইপিসিসি) সম্প্রতি রিপোর্টে উল্লেখিত জাতিসংঘের বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করেছে, মানুষের নানা কর্মকান্ডের পরিণতিতে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা দ্রুত বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত বরফ গলছে। মেরু অঞ্চলের বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বণ নিঃসরণের মাত্রাও বেড়ে চলেছে। ফলে বিভিন্ন জীবজন্তুর আবাসস্থল বদলাচ্ছে। এই শতকের শেষভাগে যদি বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তবে তার পরিণতি কী হতে পারে ভয়াবহ। সর্বশেষ প্রাপ্ত ভীতিকর দিক হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সমুদ্র এবং বরফে আচ্ছাদিত অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলার ফলে প্রণিজগতের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বজুড়ে মানুষের দৈনন্দিন নানা কর্মকান্ডে পরিবেশে যে বাড়তি তাপ তৈরি হচ্ছে তার ৯০ শতাংশই শুষে নেয় সাগর। ১৯৯৩ সাল থেকে শুষে নেওয়ার এই মাত্রা দ্বিগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে গলছে অ্যান্টারর্কটিকা এবং গ্রিনল্যান্ডের বরফও। সারা বিশ্বে প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার হিমবাহ রয়েছে, যা পৃথিবীর সাত লাখ ৩০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিদ্যমান। এ থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৭ সেন্টিমিটার।

বিশেষ করে, আন্দিজ, মধ্য ইউরোপ ও উত্তর এশিয়ায় যেসব হিমবাহ রয়েছে, সেগুলোর বরফ ২১০০ সাল নাগাদ ৮০ শতাংশ গলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই সব বরফগলা পানি গিয়ে পড়বে সাগরে। তবে আইপিসির শেষ রিপোর্টে জানা যায়, ২১০০ সাল নাগাদ সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা ১.১ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে যা আগের ধারণার চেয়ে ১০ সেন্টিমিটার অধিক। আর তা হলে মারাত্মক পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বিশ্বের এক ডজনের বেশি বড় বড় শহর।

পরিবেশবাদীদের আশঙ্কা, সাগরের উচ্চতা বাড়লে নিচু উপকূলীয় এলাকার ৭০ কোটি মানুষ বিপদে পড়বে। সাগরের তাপমাত্রা বাড়লে আবহাওয়াও দিন দিন বিরূপ আচরণ শুরু করবে। জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেড়ে যাবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের বেশকিছু এলাকায় বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কাও করছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশে বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার, যা মোট জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক ৭ ভাগ; যা মোকাবিলায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে অর্থায়নের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি নেই স্থলভাগের খুব ভেতরে বসবাসরত মানুষগুলোর। বন্যায় ক্ষতির মাত্রা বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যেতে পারে। সাগরের ৯০ শতাংশ প্রবাল বিলীন হতে পারে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। মাছের শরীরে পারদের মাত্রা বেড়ে গেলে জলজ প্রাণীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বাড়তি তাপ। সাগরের তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে ২০৩০ সালের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি নিশ্চিতকরণের জন্য জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, কার্বন নিঃসরণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমানোর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বর্তমান বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে মাত্র ০.৫৬ শতাংশ বাংলাদেশ অবদান রাখলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশর ক্ষতির পরিমান অবর্ণনীয়। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে অর্থ বরাদ্দে আজও তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি।

আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে আসেনি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। অথচ ২০১৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য বাধ্যতামূলক চুক্তিরও সিদ্ধান্ত ছিল। বিগত দিনে মেক্সিকোর কানকুন সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে একটি আইনি বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তিতে পৌঁছানো, অর্থায়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা এবং পরিরর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এছাড়াও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রতিরোধে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্য নির্ধারণে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমান শতকরা ৪০ ভাগ কমিয়ে আনার কথা ছিল। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে এক অঙ্গীকারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে কম থাকে সেই ব্যাপারে বিশ্বের সকল দেশ একাত্মতা ঘোষণা করে।

চুক্তিতে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে এনে কোপেনহেগেন ‘গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড’ গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু এসব উদ্যোগ উষ্ণায়ণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। জলবায়ু কর্মসম্মেলনে ‘গ্লোবাল কমিশন অন এ্যাডাপটেশন’ (জিসিএ) বাংলাদেশের সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং সামর্থ্যরে স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি কার্বন অনিঃসরণকারী দেশ হিসাবে স্থিতিস্থাপকতা বাড়াতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা স্পষ্ট যে, কার্বন নিঃসরণ কার্যকরভাবে বন্ধ বা হ্রাস করা সম্ভব না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বর্তমান শতাব্দীতে তীব্রতর হতে থাকবে। ভবিষ্যতে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যেসব অঞ্চলে পর্যাপ্ত ক্ষতি হয়েছে সেখানে অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি হ্রাসে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উন্নত বিশ্বের কাছে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে একযোগে কাজ করার সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রশ্নে বিশ্বের ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিযোজন প্রক্রিয়ায় এবং বিকল্প জ্বালানির সন্ধানে সহায়তার লক্ষ্যে উন্নত বা তুলনামূলক ধনী দেশ ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর অর্থ সহায়তা এবং এই অর্থের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির যে প্রস্তাব রয়েছে তা বাস্তবায়ন আবশ্যক।

অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বলে অভিমত বিশ্বব্যাংকের। গেল ৫০ বছরে দেশ ঘূর্ণিঝড়ে মুত্যুর সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি বাড়তে থাকায় অভিযোজন প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। নিম্ন কার্বন উন্নয়ন গতিপথ বাংলাদেশের অভিঘাতসহিষ্ণু আগামীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ মাত্রার বায়ুদূষণের ফলে বাংলাদেশে জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদুষণ এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে কমিয়ে আনতে পারে যা; ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ হলেও বিপুল জনসংখ্যা ও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে দেশের উন্নয়ন পথধারা গতানুগতিকভাবে চলতে থাকলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখজনকভাবে বেড়ে যাবে। দেশের শিল্পগুলোকে অধিকতর টেকসই পথে রূপান্তর করা গেলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দ্রুত নগরায়ণ, আয় প্রবৃদ্ধি এবং আয় বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বর্তমান জ্বালানি ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে জ্বালানি সংরক্ষণ, গতানুগতিক জ্বালানি চাহিদা হ্রাস, বিদ্যমান যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দক্ষতার উন্নয়ন, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার জোরদার করা জরুরি।

বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব প্রতিরোধ নিশ্চিত করে সামষ্টিক উন্নয়নে সাহায্য-সহযোগিতা বিনিময়, উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণসহ পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ক্ষরাসহিষ্ণু কৃষিপণ্য উৎপাদন, আধুনিক পদ্ধতিতে শস্য ও বীজ সংরক্ষণসহ কৃষিজমি রক্ষার্থে বনভূমি উজাড়, জলাধার ভরাট বন্ধ করা ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই। ব-দ্বীপ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য প্রকল্পিত দীর্ঘ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০, নীতি এবং অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ডেল্টা ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্রোচ গ্রহণ পরিবেশের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে।

কপ-২৭ সম্মেলনের এক প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোর বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন পড়বে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের জন্য ধনী দেশগুলো দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে অন্তত ২ লাখ কোটি ডলার প্রয়োজন হবে। দেশগুলোর মূল বাজেটের বাইরে এই অর্থ সহায়তা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রদান করতে হবে। মিসরে চলমান জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিবেদনে এই অর্থ কার্বন নিঃসরণ কমানো, স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি, জলবায়ৃ পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করে পরিবেশ ও ভূমি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে ব্যয় করা হবে বলে জানা যায়।

জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানের পাশাপাশি দেশের উদ্ভাবন ও দক্ষতাকে সফলতার সাথে এগিয়ে নিতে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অধিক সম্পৃক্ততা জরুরি হয়ে পড়েছে। চরম ঝুঁকির মধ্যে থাকা মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে, যার সমাধান জনগণের কাছে বিশ্ব নেতৃত্বের দায়বদ্ধতার ওপর নির্ভর করবে। জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা মানুগুলোকে বাঁচাতে না পারলে বিশ্বসভ্যতাই হুমকির মুখে পড়বে।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top