alt

উপ-সম্পাদকীয়

আইএমএফ’র ঋণ কতটুকু স্বস্তি দেবে?

রেজাউল করিম খোকন

: বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ ইতিবাচক। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করতেও তারা নারাজ। বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচিটি সফলভাবে করতে যাচ্ছে বলে আইএমএফ দল খুশি। সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের দল যা যা পেয়েছে, তা প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরবে ওয়াশিংটনে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের কাছে। এরপর বাংলাদেশকে দেয়া শর্তগুলো সংস্থাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করবে।

রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আইএমএফের কিছু পরামর্শ আছে। সরকারও সেভাবে কাজ করছে। আইএমএফ তিন মাসের মধ্যে এই ঋণের আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করবে। সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেবে তারা। প্রথম কিস্তির ঋণ মিলবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। আর সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। আইএমএফের ঋণের সুদহার হবে বাজারদর অনুযায়ী। তাতে গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। এ ঋণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা।

আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বিষয়ে সংস্কারে সম্মত হয়েছে সরকার। এগুলো হলো- বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জায়গা তৈরি করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা। এতে বলা হয়েছে, বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জন্য উচ্চ রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করা হবে, যা প্রবৃদ্ধি-সহায়ক খরচ বাড়াতে সহায়ক হবে। অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের ওপর প্রভাব মোকাবিলায় উচ্চ সামাজিক ব্যয় করা হবে এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অধিকতর লক্ষ্যনির্দিষ্ট হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতির দিকেই দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। মুদ্রার বিনিময় হার অধিকতর উন্মুক্ত করলে বহিঃস্থ অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়ক হবে, মনে করছে আইএমএফ। এছাড়া আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমাতে তদারকি, সুশাসন এবং রেগুলেটরি কাঠামো জোরদার করা হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশের উন্নতি করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং বাড়তি অর্থায়ন যোগাড় করা হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে। তার মধ্যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে কোনো শর্ত ছাড়া। প্রথম কিস্তির ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার বাংলাদেশ পাবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবে পরের কিস্তিগুলো পেতে হলে সংস্থাটির দেয়া শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। শর্তের মধ্যে অন্যতম আর্থিক খাতের সংস্কার। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাত ও রাজস্ব খাত। সম্ভাব্য শর্তগুলো পূরণ না করলে কিস্তির অর্থ দিতে দেরি, এমনকি আটকেও দিতে পারে আইএমএফ।

নিজের দেশের লোকেরা এতদিন সংস্কারের কথা বলে এলেও সরকার তা কানে নেয়নি। আইএমএফের কথা শুনে এখন সংস্কারে মনোযোগ দেবে। ভালো হলো যে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করতে তেমন সমীক্ষা করতে হবে না। কারণ, মৌলিক কাজগুলো আইএমএফ করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে, তা মোকাবিলায় অর্থ দিচ্ছে আইএমএফ। এ অর্থ অপচয় করা যাবে না। করলে ঋণটা বোঝা হয়ে যাবে।

আর আর্থিক খাত সংস্কারে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অন্য সংস্থাগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সংস্কার অসম্ভব। প্রতিটি কিস্তি দেয়ার আগে আইএমএফের একটি মিশন আসবে ঢাকায়। এটাই তাদের নিয়ম। কিস্তি ছাড়ের আগে সফরে এসে তারা দেখবে শর্তগুলো ঠিকঠাকভাবে পূরণ হচ্ছে কিনা। ফিরে গিয়ে আইএমএফের পর্ষদে আবার প্রতিবেদন দাখিল করা হবে মিশনের পক্ষ থেকে। শর্ত পূরণ না হলে তখন পরের কিস্তির অর্থ আটকেও দিতে পারে আইএমএফ। তাদের শর্ত পূরণ সরকারের জন্য তেমন কঠিন হবে না।

কারণ, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের কিছু কাজ এমনিতেই করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার যে কম, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। আইএমএফ তাগিদ দিচ্ছে রাজস্ব-জিডিপি হার বাড়াতে। সরকার নিজেও তা চায় এবং এজন্য কাজও চলছে। রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় সংসদে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন, এগুলো প্যাকেজ আকারে আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হবে। আইএমএফও সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে।

ব্যাংক খাত সংস্কারের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা, বছরে চারবার মুুদ্রানীতি করা ইত্যাদি কাজ করতে আপাতত সম্মত হয়েছে সরকার। আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে চার বছরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে, তার আগে ওই কিস্তির দ্বিগুণের বেশি পরিমাণ রিজার্ভ কমে যাবে। গত ছয় মাসের প্রবণতা হচ্ছে, প্রতি মাসেই ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমছে। তাই ঋণের ওপর পুরো ভরসা না করে বা ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বলে স্বস্তিতে না থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।

চাপের মুখে দেশের অর্থনীতি। সংকটের যে বিস্তৃতি, তাতে এই ঋণ অর্থনীতিতে কতটুকু স্বস্তি দেবে? আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে- এটা স্বস্তির খবর। অর্থের অঙ্কে এই ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের সব সমস্যা মিটবে না। এমনকি সব অর্থও একসঙ্গে পাওয়া যাবে না, তারপরও বলা যায়, এই ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া আইএমএফের ঋণ দেয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরের এক ধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্য সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করবে।

প্রথম কিস্তিতে বাংলাদেশ ৪৫ কোটি ডলার পাবে, এটি আমাদের রিজার্ভের সাপেক্ষে তেমন কিছু নয়। আইএমএফের হিসাবে, আমাদের যে রিজার্ভ, তার সাপেক্ষেও এটি বড় কিছু নয়। কিন্তু আগামি দিনতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত হবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়, সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে। ঋণের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ-এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে।

সুশাসনের অভাবের কথাও অনেক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। শুধু রিজার্ভ নয়, ব্যয় করার মতো অর্থের অভাব আছে আমাদের। সুতরাং আমরা সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদেরই লাভ। এসব করা গেলে আমাদের খেলাপি ঋণ কমবে বা রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পাবে। আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো নিজেদের গরজেই করা উচিত। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য এটি জরুরি।

আইএমএফের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা। এটা নতুন কিছু নয়, দেশের অর্থনীতিবিদরা অনেকদিন ধরেই এসব বলে আসছেন। এসব কিছু শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি। আইএমএফ ঋর্ণুকি হ্রাসের কথা বলেছে। সেটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক, তাও বলা যায় না। তবে কোন খাতে আমরা সমন্বয় করা প্রয়োজন, তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা যেন হুমকির মুখে না পড়ে, তা বিবেচনায় নিয়ে ঋর্ণুকি হ্রাসের কথা ভাবতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

চিকিৎসা জগতের বাতিঘর জন হপকিনস বিশ^বিদ্যালয়

জলবায়ু পরিবর্তনের দৃশ্যমান প্রভাব

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ও আজকের বাংলাদেশ

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

tab

উপ-সম্পাদকীয়

আইএমএফ’র ঋণ কতটুকু স্বস্তি দেবে?

রেজাউল করিম খোকন

বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে ঋণ দেয়ার ব্যাপারে আইএমএফ ইতিবাচক। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করতেও তারা নারাজ। বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচিটি সফলভাবে করতে যাচ্ছে বলে আইএমএফ দল খুশি। সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের দল যা যা পেয়েছে, তা প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরবে ওয়াশিংটনে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের কাছে। এরপর বাংলাদেশকে দেয়া শর্তগুলো সংস্থাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করবে।

রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য আইএমএফের কিছু পরামর্শ আছে। সরকারও সেভাবে কাজ করছে। আইএমএফ তিন মাসের মধ্যে এই ঋণের আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করবে। সাত কিস্তিতে এই ঋণ দেবে তারা। প্রথম কিস্তির ঋণ মিলবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। আর সর্বশেষ কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে। আইএমএফের ঋণের সুদহার হবে বাজারদর অনুযায়ী। তাতে গড় সুদহার হবে ২ দশমিক ২ শতাংশ। এ ঋণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে রক্ষা করে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা।

আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বিষয়ে সংস্কারে সম্মত হয়েছে সরকার। এগুলো হলো- বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জায়গা তৈরি করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা। এতে বলা হয়েছে, বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জন্য উচ্চ রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করা হবে, যা প্রবৃদ্ধি-সহায়ক খরচ বাড়াতে সহায়ক হবে। অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের ওপর প্রভাব মোকাবিলায় উচ্চ সামাজিক ব্যয় করা হবে এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অধিকতর লক্ষ্যনির্দিষ্ট হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতির দিকেই দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবায়িত হবে। মুদ্রার বিনিময় হার অধিকতর উন্মুক্ত করলে বহিঃস্থ অভিঘাত মোকাবিলায় সহায়ক হবে, মনে করছে আইএমএফ। এছাড়া আর্থিক খাতের দুর্বলতা কমাতে তদারকি, সুশাসন এবং রেগুলেটরি কাঠামো জোরদার করা হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশের উন্নতি করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং বাড়তি অর্থায়ন যোগাড় করা হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে। তার মধ্যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে কোনো শর্ত ছাড়া। প্রথম কিস্তির ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার বাংলাদেশ পাবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। তবে পরের কিস্তিগুলো পেতে হলে সংস্থাটির দেয়া শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। শর্তের মধ্যে অন্যতম আর্থিক খাতের সংস্কার। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাত ও রাজস্ব খাত। সম্ভাব্য শর্তগুলো পূরণ না করলে কিস্তির অর্থ দিতে দেরি, এমনকি আটকেও দিতে পারে আইএমএফ।

নিজের দেশের লোকেরা এতদিন সংস্কারের কথা বলে এলেও সরকার তা কানে নেয়নি। আইএমএফের কথা শুনে এখন সংস্কারে মনোযোগ দেবে। ভালো হলো যে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করতে তেমন সমীক্ষা করতে হবে না। কারণ, মৌলিক কাজগুলো আইএমএফ করে দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে, তা মোকাবিলায় অর্থ দিচ্ছে আইএমএফ। এ অর্থ অপচয় করা যাবে না। করলে ঋণটা বোঝা হয়ে যাবে।

আর আর্থিক খাত সংস্কারে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অন্য সংস্থাগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সংস্কার অসম্ভব। প্রতিটি কিস্তি দেয়ার আগে আইএমএফের একটি মিশন আসবে ঢাকায়। এটাই তাদের নিয়ম। কিস্তি ছাড়ের আগে সফরে এসে তারা দেখবে শর্তগুলো ঠিকঠাকভাবে পূরণ হচ্ছে কিনা। ফিরে গিয়ে আইএমএফের পর্ষদে আবার প্রতিবেদন দাখিল করা হবে মিশনের পক্ষ থেকে। শর্ত পূরণ না হলে তখন পরের কিস্তির অর্থ আটকেও দিতে পারে আইএমএফ। তাদের শর্ত পূরণ সরকারের জন্য তেমন কঠিন হবে না।

কারণ, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের কিছু কাজ এমনিতেই করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার যে কম, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। আইএমএফ তাগিদ দিচ্ছে রাজস্ব-জিডিপি হার বাড়াতে। সরকার নিজেও তা চায় এবং এজন্য কাজও চলছে। রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় সংসদে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন, এগুলো প্যাকেজ আকারে আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হবে। আইএমএফও সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে।

ব্যাংক খাত সংস্কারের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা, বছরে চারবার মুুদ্রানীতি করা ইত্যাদি কাজ করতে আপাতত সম্মত হয়েছে সরকার। আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে চার বছরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে, তার আগে ওই কিস্তির দ্বিগুণের বেশি পরিমাণ রিজার্ভ কমে যাবে। গত ছয় মাসের প্রবণতা হচ্ছে, প্রতি মাসেই ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমছে। তাই ঋণের ওপর পুরো ভরসা না করে বা ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বলে স্বস্তিতে না থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।

চাপের মুখে দেশের অর্থনীতি। সংকটের যে বিস্তৃতি, তাতে এই ঋণ অর্থনীতিতে কতটুকু স্বস্তি দেবে? আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে- এটা স্বস্তির খবর। অর্থের অঙ্কে এই ঋণ তেমন বড় কিছু নয়। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের সব সমস্যা মিটবে না। এমনকি সব অর্থও একসঙ্গে পাওয়া যাবে না, তারপরও বলা যায়, এই ঋণ বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

এছাড়া আইএমএফের ঋণ দেয়ার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবরের এক ধরনের বার্তা আছে। এটি বহুপক্ষীয় অন্য সংস্থাগুলোকে আশ্বস্ত করবে।

প্রথম কিস্তিতে বাংলাদেশ ৪৫ কোটি ডলার পাবে, এটি আমাদের রিজার্ভের সাপেক্ষে তেমন কিছু নয়। আইএমএফের হিসাবে, আমাদের যে রিজার্ভ, তার সাপেক্ষেও এটি বড় কিছু নয়। কিন্তু আগামি দিনতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান আমাদের বাজেট সহায়তা দিতে উৎসাহিত হবে। বাজেট সহায়তাও কিন্তু রিজার্ভে যোগ হয়, সেদিক থেকে এর গুরুত্ব আছে। ঋণের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, এনবিআরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, জ্বালানি খাতের ক্যাপাসিটি চার্জ-এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে।

সুশাসনের অভাবের কথাও অনেক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। শুধু রিজার্ভ নয়, ব্যয় করার মতো অর্থের অভাব আছে আমাদের। সুতরাং আমরা সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারলে আমাদেরই লাভ। এসব করা গেলে আমাদের খেলাপি ঋণ কমবে বা রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পাবে। আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণ আলোচনায় যেসব বিষয় উঠে এসেছে, সেগুলো নিজেদের গরজেই করা উচিত। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য এটি জরুরি।

আইএমএফের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল মুদ্রার বিনিময় হার বাজারমুখী করা। এটা নতুন কিছু নয়, দেশের অর্থনীতিবিদরা অনেকদিন ধরেই এসব বলে আসছেন। এসব কিছু শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসা জরুরি। আইএমএফ ঋর্ণুকি হ্রাসের কথা বলেছে। সেটা একেবারে অপ্রাসঙ্গিক, তাও বলা যায় না। তবে কোন খাতে আমরা সমন্বয় করা প্রয়োজন, তা আগে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা যেন হুমকির মুখে না পড়ে, তা বিবেচনায় নিয়ে ঋর্ণুকি হ্রাসের কথা ভাবতে হবে।

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top